মুরশিদুজ্জামান হিমু:
এ এক আজব শহর ঢাকা। কী নেই এখানে? যা চান, সব পাবেন। সাত সকালে বিরিয়ানি খেতে চান, পাবেন। মধ্যরাতে লাল পানি বাসায় দরকার? পেয়ে যাবেন হাতের তুড়িতেই। মৌসুমি সবজি স্বভাবত পাওয়া যাবে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু এটা তো ঢাকা। মৌসুম-ফৌসুম নাই, সারা বছরই পাবেন তথাকথিত মৌসুমি সবজি-ফল। সব পাওয়া যায় এখানে, সব। বড় রেস্টুরেন্টে যাবেন, আস্ত আলু সেদ্ধ করে সার্ভ করবে আপনাকে। বলবে ‘ম্যাশড পটেটো’। ভুট্টা ভেজে বিক্রি করবে, বলবে ‘পপকর্ন’। আসলেই এ এক আজব শহর!
শহর যেহেতু আজব, সেখানে আজব সবকিছু ঘটবে, এটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিদিন দেখবেন, হাসবেন, তাজ্জব বনে যাবেন। এই তো প্রাণের (!) শহর। কেউ আবার বলেন জাদুর শহর। এখানে নাকি কবি হাসে, টাকা ভাসে। কেউ টাকা ওড়া নিজ চোখে দ্যাখে, কেউ অন্যের দেখা টাকা ওড়ার গল্প শুনে মজা পায়। কেউ সুখের চাদরে মোড়ানো বিছানায় ঘুমায়। কেউ ফুটপাতের শক্ত কনক্রিটের ওপর। কেউ প্রাণ খুলে শ্বাস নেয়, কেউ শ্বাস নিতেই ভয় পায়। কেন পায়? জানে না নিজেই। আজব শহর বলে কথা!
এই শহরে বর্ষায় রাস্তায় হাটুপানি জমে। বছরের পর বছর ধরেই চলছে এমন। কোন জায়গার কথা বলবেন, গুলশান-ধানমণ্ডি, বাড্ডা-যাত্রবাড়ী? সব জায়গাতেই পানি জমে। অভিজাত বলে কোনো কথা নেই। পানি না জমলেই বরং টেনশন। এত তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে গেল সব? বেশি ভাল তো ভাল না।
এবার তো আগের সব ইতিহাসের নাকানি-চুবানি। কত লোক মারা গেল শুধু মশার কামড় খেয়ে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। কতদিন ধরে এই ভীতি চলল। কিন্তু কেউ কিছু কি করতে পারল? সরকার আছে, আছে নাকি নগরপিতাও। অভিভাবকের তো অভাব নাই। কিন্তু কেউ কিছু করল না বোকা জনগণের জন্য। ছোট্ট মশার কাছে কুপোকাত দীর্ঘদেহী সব মানুষ। আসলেই, আজব শহর বলেই সম্ভব এটা।
এই শহরে কেউ উত্তরা থেকে কোন কাজে মতিঝিল যেতে চাইলে আগের দিন থেকে আদা-জল খেয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়। সে এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প। গণমানুষ হয়ে লোকাল গাড়িতে চড়ে বসুন। কখনও না কখনও আপনি ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছাবেন, গ্যারান্টি দিয়ে একথা বলা যায়। কিন্তু কত সময় লাগবে, এর গ্যারান্টি-ওয়ারেন্টি কেউ দিতে পারে না। কেন রাস্তায় এত যানজট? উত্তর, আজব শহর না?
এই শহরে বিনোদনের মানে কী? বন্ধের দিনে কোথায় গিয়ে একটু প্রাণখুলে শ্বাস নেবেন, এই তো। ভাবছেন কোথায় যাবেন। শেষমেষ ভেবে নিশ্চিত বের করবেন বাসার কাছে কোন রেস্টুরেন্টে যাবেন। বাচ্চার জন্য লাফালাফির একটা কর্নার আছে। আপনাদের জন্য গলাকাটা দামে ফ্রাইড রাইস বা ফ্রাইড চিকেন রেডি। ভারি খাবার খেয়ে সাথে একটু কোক বা মাউন্টেন ডিউ। স্ট্যাটাস বাড়াতে চাইলে সোডা পানি। ব্যস, বিনোদন কমপ্লিট। এরপর সোজা বাসায় এসে টিভিতে ডুবে পড়ুন। আপনি আজব শহরের বাসিন্দা না?
বাচ্চাকে স্কুলে দিতে হবে। ঢাকা শহরের বড় বড় স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম সব। ভর্তি করান, দু’বছর পর থেকে মায়ের শেখানো বাংলা ভুলে যেতে শুরু করবে আপনার বাচ্চা। বলবে, হায় ড্যাডি, লেটস গো ফর…। আপনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবেন। হয়ত মনে মনে ভাববেন, সব উচ্ছন্নে গেল। কিন্তু কী-ই বা করার আছে আপনার? আপনি আজব শহরে বড় করছেন না আপনার সন্তানকে?
আসলেই এ এক আজব শহর। এখানে ছফা-হুমায়ূন নিয়ে যতটা না চর্চা হয়, তার থেকে বেশি হয় তাহিরী আর হিরো আলমদের নিয়ে। তরুণরা আজকাল কবিতার আসর বসায় না। লাল-নীল আলোয় বসায় ধোঁয়ার আসর। টি-শার্টে বুকে যতটা না চে গেভারা লেপ্টে থাকে, তার থেকে বেশি থাকে সেফুদা। রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’র মতো চরণ ভাইরাল হয় না আজকাল, ভাইরাল হয় ‘মদ খা বা ঢেলে দেই’র মত কথা। আসলেই আজব শহর না?
এভাবেই চলছে এই শহর। তাই এর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিন। ডেঙ্গুকে আলিঙ্গণ করুণ। জলাবদ্ধতাকে আপন করে নিন। ট্রাফিক জ্যামকে খালাতো ভাই না ভেবে সহোদর ভাবুন। দেখবেন জীবন কত সুন্দর, আনন্দময়। যদি মানিয়ে নিতে না পারেন, তবে আপনি অযোগ্য, অপদার্থ। এই জাদুর (!) শহরে থাকার অধিকার আপনার নেই। আর আপনি না থাকলে উত্তর-দক্ষিণ কারোই কিচ্ছু যায় আসে না।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
Leave a reply