ডিটেকটিভ রুদ্র মাহমুদ, বেশ ভারি নাম। শুনে মনে হতেই পারে গল্পের মাসুদ রানা যেন অন্যকোন নামে অন্যকোন চরিত্র নিয়ে নতুন কোন মিশন নিয়ে হাজির হয়েছে নতুন কোন দেশে।
ফেসবুকে এমন নামে কোন প্রোফাইল দেখলেই ঢুঁ মেরে আসতে মন চাইবে যে কারো। কিন্তু অস্ত্র হাতে মধ্যবয়সী একজন সুদর্শন তরুণের প্রোফাইলের আড়ালে লুকিয়ে আছে শহিদুল ইসলাম খান ওরফে এস আই খান নামে এক ভয়ংকর প্রতারক।
নিজেকে কানাডা প্রবাসী দাবি করে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছেন নানা পরামর্শ আর দিকনির্দেশনা। আর যেকোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার পর তার সাথে যোগাযোগ করার কথা বলা হয়। সেখানেও থাকে চটকদার বক্তব্য, প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাজ করার কারণে ব্যস্ত থাকেন দিনের বেশিরভাগ সময়ই ফলে যোগাযোগ নিয়মিত না হলেও যাতে তাকে যে কোন প্রশ্ন করেত কার্পণ্য না করে তাও বলে দেয়া হয়। যোগাযোগের জন্য সেখানে তার ব্যক্তিগত মোবাইল, হোয়াটস এ্যাপ, ইমো ও কানাডার ঠিকানাও দেয়া আছে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে যেয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন নানা প্রলোভনমূলক আর্টিকেলও। পরামর্শ দেন সবকিছু জেনে নেয়ার যাতে পরবর্তীতে কোন ফাঁদে না পড়তে হয়। আর এইসব প্রলোভন দেখিয়ে নিজেই ফাঁদে ফেলেন মানুষজনকে।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তার প্রতি আকর্ষিত করতে তিনি আশ্রয় নেন কানাডা প্রবাসীদের নামে লিখা নানা কাল্পনিক গল্পের। নিজেকে বিভিন্ন সময় মানবাধিকার কর্মী, সিএনএনের বাংলাদেশে প্রতিনিধি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশালের বড় কর্মকর্তা, একাধিক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বার্তা সম্পাদক ও প্রতিরক্ষা বার্তা সংস্থার মহাসচিবসহ নানা ভুয়া পরিচয় দিয়ে সেখানে তুলে ধরা হয় অভিবাসী জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, দুঃখ দুর্দশা ও সাফল্যের গল্প। আর এগুলো দেখেই মানুষ আগ্রহী হয় তার পরামর্শ নেয়ার জন্য।
যখনই কেউ তার এসব প্রলোভনে পড়ে তাদেরকে পরবর্তীতে বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে কানাডায় চাকরির ব্যবস্থা ও ভিসা পাইয়ে দিতে সহায়তার কথা বলে হাতিয়ে নেন ৪ থেকে ১২ লাখ টাকা। এভাবেই অভিনব প্রতারণার ফাঁদ পেতে বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকার মালিক।
শেষ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উত্তর বিভাগের হাতে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার হন এসআই খান। অন্যরা হলেন- মো. আবদুল মান্নান, আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান ঢালী। বর্তমানে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এলো এইচএসসি পাস এসআই খান কখনও কানাডায় যাননি।
পুলিশের কাছে এই প্রতারক জানান, তিন বছর ধরে ফেসবুকে ভুয়া ডিটেকটিভ পরিচয় দিয়ে একটি গ্রুপ চালান তিনি। টাকার বিনিময়ে দুই ব্যক্তি ওই গ্রুপে কানাডা-সংক্রান্ত বিভিন্ন আর্টিকেল লিখে তার নামে পোস্ট করতেন। এছাড়া কয়েক লাখ ফলোয়ার দেখাতে পোস্টগুলো ‘বুস্ট’ করাতেন তিনি।
রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এসআই খান। কয়েক বছর আগে কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ৮ লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার পর নিজেই প্রতারণায় যুক্ত হন।
এসআই খান বলেন, ‘আমার পরিচয় প্রতারক। তবে যে পথে প্রতারিত হয়েছি, সেই পথে প্রতারণা করে লাখ টাকা আয় করেছি। কখনও ভালো হওয়ার সুযোগ পেলে সুপথে ফিরব।’
এসআই খানের সহযোগী মিজানুর রহমান ঢালী জানান, তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের আবদুল মান্নানের মাধ্যমে এসআই খানের সঙ্গে পরিচয় হয়। যারা কানাডায় অভিবাসনপ্রত্যাশী ছিলেন তাদের সঙ্গে চুক্তি হতো এসআই খানের। তবে তারা কখনও সরাসরি তাকে দেখেননি। তার সঙ্গে মোবাইল বা অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করলে তিনি বলে দিতেন, কার কাছে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। উত্তরায় এপি ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তার কাছে তিনজন ৯ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় দিয়ে যান। তার মধ্যে অর্ধেক টাকা মিজান রেখে বাকিটা এস আই খানকে দিয়েছেন।
প্রতারক চক্রের সদস্য আবদুল মান্নান জানান, তার মেয়ের বিয়েবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ঝামেলা তৈরি হলে এসআই খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। কারণ তার জানা ছিল এসআই খান বড় মানবাধিকার কর্মী। তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। সর্বশেষ বছর দুয়েক আগে কানাডায় ভিসা দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার ফাঁদ তৈরির কথা এসআই খান জানান তাকে। লোভে পড়ে মান্নান ওই পেশায় যুক্ত হন।
ডিবির উত্তর বিভাগের এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লু বলেন, ‘কথিত রুদ্র মাহমুদ তার ফেসবুক প্রোফাইলে যে ছবি ব্যবহার করেছে সেটি আরেকজনের। সে অত্যন্ত ধূর্ত। তার সঙ্গে কথা বললে যে কারও মনে হবে সে অত্যন্ত শিক্ষিত। বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলত রুদ্র। যাতে অন্য প্রান্তে কানাডার নম্বর দেখা যায়।’
Leave a reply