তোয়াহা ফারুক:
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও নৈতিক স্খলনের দায়ে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ হারাতে হয়েছে। শীর্ষ দুই নেতার এমন পরিণতিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের মাঝে। বিশেষ করে এ দুই নেতার অনুসারীরা পড়েছেন দিশেহারা অবস্থায়। মাত্র দুটি ছাড়া কোনো সাংগঠনিক ইউনিটে কমিটি করে যেতে পারেননি শোভন-রাব্বানী। ইউনিটগুলোতে যারা পদ প্রত্যাশী ছিলেন ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব তাদের ঠাঁই দেবেন কিনা এ নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেছেন তারাও।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সহসভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ সংগঠন বহির্ভূত কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। তাদের চিহ্নিত করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পদ বঞ্চিত নেতাকর্মীরা আন্দোলনও করেছিলেন। ব্যবস্থা নেয়ার কথা দিলেও এ বিষয়ে কিছুই করেননি শোভন-রাব্বানী। এখন তো তারাই নেই। স্বভাবতই শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতাকর্মী আছেন আতঙ্কে। বলাই বাহুল্য, ছাত্রলীগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠিন বার্তা তাদের জন্য সুখকর নয়। পাশাপাশি, শোভন-রাব্বানীর অনুসারীদের মধ্যেও কাজ করছে অনিশ্চয়তা।
এতদিন, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য যথাক্রমে শোভন ও রাব্বানীর সাথে রাজনীতি করেছেন। এই যুক্তি দেখিয়ে অনেকে বলছেন, বড় ধরনের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তেই শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে তাদের দায়িত্ব দেওয়ায় কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সাহস পাবে না।
তবে, এর বিপরীত যুক্তিও দিয়েছেন শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সাবেক ও বর্তমান নেতা। তাদের কথা, আল নাহিয়ান খান জয় শোভনের সাথে রাজনীতি করলেও সেটি ছিল বাধ্য হয়ে করা। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করে আসা জয় আসলে শোভনের চেয়ে অনেক পরিণত। তিনি জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক থেকে পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপরই তার ডাক আসে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সোহাগ-জাকির কমিটিতে আইন বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়েছিলেন জয়। বর্তমান কমিটি গঠনের সময় সভাপতি পদে তিনিও আলোচনায় ছিলেন। পরবর্তীতে শোভন সভাপতি হওয়ায় তাকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি করা হয়। জয়ের আলাদা রাজনৈতিক ভাবনা ও কৌশল থাকবে যেটি শোভনের অনুসারীদের দিয়ে বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য হবে।
তাছাড়া, জয় বরিশাল বেল্টের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শোভন-রাব্বানী নেতা হওয়ার পর এই বেল্ট অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। বিগত ডাকসু নির্বাচনে শোভন বরিশাল ও খুলনা বেল্টের ভোট পায়নি বলে বদ্ধমূল ধারণা আছে তার আনুসারীদের মধ্যে। দু’পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে অস্বস্তিও ছিল। জয় নেতৃত্বে আসায় ছাত্রলীগে বরিশাল অঞ্চলের নেতাকর্মীরা নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠেছেন।
আতঙ্ক কাজ করছে রাব্বানীর অনুসারীদের মধ্যেও। তার পদচ্যুতির ফলে দীর্ঘদিন পর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে মাদারীপুর অঞ্চলের কেউ নেই। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য রাব্বানীর সাথে রাজনীতি করলেও তিনি মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রিন্সের অবর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। লেখকের বাড়ি যশোর অঞ্চলে। প্রিন্সের সাথেই বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের রাজনীতির দেখভাল করতেন লেখক। শোভন-রাব্বানীর নেতৃত্বের প্রথমদিকে খুলনা অঞ্চলের নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলেও প্রথমে খুলনা অঞ্চলের কেউ ছিল না। এটি নিয়ে একাধিক সাবেক নেতার ক্ষোভ প্রকাশের ভিত্তিতে পরবর্তীতে প্যানেলে খুলনা অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময় এদিকে শোভন-রাব্বানীর দৃষ্টি ছিল। কিন্তু, সেটি কতটা কাজ দিয়েছে তা সময়ই বলে দিবে।
এদিকে, শোভন-রাব্বানী পদ হারানোয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ইউনিটগুলোর নেতাকর্মীরা দিশেহারা অবস্থায় পড়েছেন, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের ইউনিটগুলোর নেতাকর্মীরা। খুব শীঘ্রই কমিটি হবে এমন আশা করে প্রায় সকল পদ প্রত্যাশী শোভন-রাব্বানীর পেছনে ছুটেছিল। নানা ধরনের লেনদেনেও জড়িয়ে পড়েছিল কেউ কেউ। তাদের এখন আবার নতুন করে সব হিসেব নিকেশ শুরু করতে হচ্ছে। কার সাথে রাজনীতি করবেন সেটিই মিলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেউ কেউ। অভিযোগ আছে, অনেক সাংগঠনিক ইউনিটের নেতা-কর্মীরা শীর্ষ নেতৃত্বকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে রেখেছিল পদের জন্য, যার কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে। আর্থিক লেনদেন করা এসব নেতাকর্মীরাও পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। তবে, নদীর এ-কূল ভাঙে তো ও-কূল গড়ে। শোভন-রাব্বানীর পরিণতিতে নতুন করে আশার আলো দেখছেন অনেক ছিটকে পড়া নেতা-কর্মী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য যমুনা নিউজকে বলেন, এত অল্প সময়ে এতগুলো সাংগঠনিক ইউনিট গঠন করে সময়মতো কাউন্সিল করাটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আমরা ছাত্রলীগের সবাইকে সাথে নিয়েই এগোতে চাই। কমিটিগুলো গঠনে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ণ করা হবে। প্রয়োজনে গোয়েন্দা রিপোর্ট ও সাংবাদিকদের তথ্য সহায়তা নেয়া হবে।
কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পাওয়ায় প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় জানান, আসলে এভাবে দায়িত্ব পাবো বুঝতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী যে আস্থা রেখেছেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তার প্রতিদান দিতে। কোনো অঞ্চল বা বেল্টের হিসেব আমরা করবো না। ছাত্রলীগের সৎ ও একনিষ্ঠ কর্মীদেরই পদ দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে।
Leave a reply