গত কয়েকদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে আলোচনায় আছে ছাত্ররাজনীতি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্পের টাকা থেকে চাঁদা চাওয়া এবং লেনদেনের অভিযোগ উঠলে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর নানান ঘটনা প্রবাহের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে পদ হারান ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে ক্ষুব্ধ হলে সংগঠনটির সাংগাঠনিক নেত্রী হিসেবে তিনি তাদেরকে সরে যেতে বলেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বে এসেছেন নতুন দুই নেতা।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার একসাথে পদ হারানোর উদাহরণ নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাটি নিয়ে সারাদেশেই আলোচনা, পর্যালোচনা। তবে সামাজিক মাধ্যমে এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছে ভার্চুয়াল জগতে অতিপরিচিত এক চরিত্র- ‘সহমত ভাই’।
এই ‘সহমত ভাই’ প্রকৃতপক্ষে কোনো ব্যক্তি চরিত্র নন। এটি একটি ‘ভার্চুয়াল পরিভাষা’। মূলত, ‘উর্ধ্বতন নেতা বা কর্তা ব্যক্তির সন্তুষ্টি অর্জনে সদাব্যস্ত সুযোগ সন্ধানী অধীনস্ত ব্যক্তি’কে বুঝাতে পরিভাষাটি ব্যঙ্গাত্মক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে প্রভাবশালী নেতা বা কর্তা কোনো পোস্ট দিলে তার কমেন্টে একদল লোককে দেখা যায় সদা ‘সহমত ভাই’, ‘সহমত স্যার’ ইত্যাদি লিখে তাদের উপস্থিতির জানান দেন। নিজেকে পোস্টকারীর সুদৃষ্টিতে আনার চেষ্টারত থাকেন।
সামাজিক মাধ্যমের এই চর্চা বাস্তব জীবনেও আছে। নেতাকে ঘিরে চারপাশে অনেকে থাকেন, এবং সর্বদা নেতার সব কথায়ই ‘সম্মতি জ্ঞাপন’ করে থাকেন। এদেরও রূপক অর্থে ‘সহমত ভাই’ বলা হয় ভার্চুয়াল পরিভাষায়। দল-মত নির্বিশেষে এই ‘সহমত ভাই’দের উপস্থিতি ও দাপট সর্বত্র।
ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা পদ হারানোর পর সংগঠনটির অন্যান্য সিনিয়র নেতারা সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় সতর্কতা অবলম্বন করলেও সাধারণ নেতাকর্মীরা নানান মত প্রকাশ করছেন। সদ্য সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সেক্রেটারি গোলাম রাব্বানী পদ হারানোর পর তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনেকেই তাদের পরিণতির জন্য আশপাশে থাকা ‘সহমত ভাই’দেরকে দায়ী করছেন।
অনেকেও এটা বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যে, এতদিন যারা শোভন-রাব্বানীর সাথে আঁটার মতো লেগে থাকতেন, তাদের ফেসবুক পেইজ ও একাউন্টে প্রতিটি পোস্টের নিচে ‘সহমত ভাই’ লিখে কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিতেন, তারা আজ দুই নেতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।
তনয় বিল্লাহ নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর ছাত্রলীগের এক নেতা ফেসবুকে লিখেছেন, “গোলাম রাব্বানী ভাই পদত্যাগের পর যখন ভারপ্রাপ্ত কমিটি দেয়া হলো, তখন সাথে সাথে (সহমত ভাই/ দুধের মাছি/ সু সময়ের কুকিল/ চামবাজ/ তেলের দোকানদার) ভাই/আপুগুলা ভাইয়ের লগে নগদ পল্টি মারছে। নতুন ভাইয়ের পিছনে আবার তেল মারার প্রস্তুতি নিতেছিল।”
আকরাম নামে আরেক ছাত্রলীগ কর্মী লিখেছেন, “ভাই আসে ভাই যায় কিন্তু আমাদের … রয়েই যায়।”
পদ হারানো দুই নেতার সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টগুলোতেও অনেকে এই ‘সহমত ভাই’দের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গোলাম রাব্বানীর একটি পোস্টে সোহরাব হোসেন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “ভুল করতেই পারেন। মানুষ মাত্রই ভুল৷ কিন্তু কথা হচ্ছে এতদিন যে আপনার পিছনে বাইক বহর থাকত, সেলফি তুলত, ফেবু তে ট্যাগ দিয়ে তেলবাজি করে আপনাকে মানবতার ফেরিওয়ালা ক্যাপশন দিতো সেইসব সহমত ভাইয়েরা আজ কোথায়?”
শুধু ছাত্রলীগ নেতাদের আশপাশে নয়, ‘সহমত ভাই’ এর উপস্থিতি এখন নেট জগতের সর্বত্র। বাস্তব জীবনে ‘সহমত ভাই’ এর প্রভাব-প্রতিপত্তি দিনদিন বাড়ছে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কনও হয়েছে।
‘সহমত ভাই’ নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হলেও সামাজিক মাধ্যমে সাধারণের প্রতিক্রিয়া থেকে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষই এই ‘সহমত ভাই’ সংস্কৃতিকে অপছন্দ করছেন।
Leave a reply