আজ ১৫ অক্টোবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস। ১৯৮৫ সালের এ তারিখে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একটি ভবন ধ্বসে পড়লে নিহত হন প্রায় ৪০ জন। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওই দিনকে শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জগন্নাথ হলে সংঘটিত মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যেসব ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি নিহত হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই দিবসটি পালিত হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও পালিত হচ্ছে দিবসটি।
শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ও প্রধান প্রধান ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালো ব্যাজ ধারণ, সকাল সাড়ে ৭টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শোক মিছিল নিয়ে জগন্নাথ হলের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও নীরবতা পালন।
এরপর সকাল ৮-৯টা পর্যন্ত অক্টোবর স্মৃতি ভবনে আলোচনা সভা, ৯-১০টা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের প্রার্থনা সভা, বাদ আছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসহ বিভিন্ন হলের মসজিদে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হবে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জগন্নাথ হল প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় নিহতদের তৈলচিত্র ও দ্রব্যাদি প্রদর্শন, সকালে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে রক্তদান কর্মসূচির আয়োজনও করা হয়েছে।
পাশাপাশি শোক দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জগন্নাথ হল উপাসনালয়ে ভক্তিমূলক গানের অনুষ্ঠান, শোক সংগীত ও কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার। তখন চিত্তবিনোদনের জন্য টিভি চ্যানেল হিসেবে বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশনই ছিল একমাত্র অবলম্বন। প্রতি মঙ্গলবারের মতো সেদিনও ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক ‘শুকতারা’। সেনা শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অগণতান্ত্রিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তখন বেগবান। ছাত্ররা প্রতিবাদে উত্তপ্ত করে রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
তখন ‘অ্যাসেম্বলি হল’ ছাত্রদের মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবশ্য তত দিনে ‘অ্যাসেম্বলি হল’ একাত্তরে শহীদ আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই ‘অনুদ্বৈপায়ন ভবনে’ ১৯৭৯ সালে টেলিভিশন সেট স্থাপন করা হয়েছিল। সেই টেলিভিশনে রাত সাড়ে ৮টায় আরম্ভ হয় নাটক। এ সময় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপজনিত কারণে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়া বয়ে যায় ও প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়।
এর মধ্যেই দু-চারজন করে প্রায় চারশ ছাত্র এলে টেলিভিশন কক্ষ ভরে ওঠে। ঠিক তখনই—তখন রাত পৌনে ৯টা, অকস্মাৎ ভবনটির ছাদ ধসে পড়ে। যারা ভেতরে জায়গা না পেয়ে দরজা বা জানালার ধারে বসে নাটক দেখছিল, তারা দৌড়ে বের হতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্রই সেদিন ছাদচাপা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং চাপা পড়া ছাত্রদের আর্তচিৎকারে জগন্নাথ হলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই হলের অন্যান্য ভবনের ছাত্র এবং খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ আর্তদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। একে তো টিপটিপ বৃষ্টি, অন্যদিকে বিদ্যুত্হীন অবস্থা—এই প্রতিকূল পরিবেশে সারারাত উদ্ধারকাজ তেমন এগোতে পারেনি।
উদ্ধারকৃতদের এক হাসপাতালে স্থান দেওয়া সম্ভব না হলে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি, সোহরাওয়ার্দী, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, পঙ্গু ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া ব্যক্তি-মালিকানাধীন ক্লিনিকেও ভর্তি হয় বহু আহত ছাত্র। মাইকে তখন রক্তদান করার জন্য করুণ আকুতি ঘোষিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং বহু সাধারণ মানুষ এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাসপাতালে চলে যায় রক্ত দিতে।
রক্তদান করার আগ্রহীদের এত ভিড় স্মরণকালে আর দেখা যায়নি। তারপরও সব জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। নিহতদের লাশ শহীদ মিনারের পাদদেশে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়। পরের দিন দেশের সংবাদপত্রগুলোর প্রধান খবর ছিল এটাই। দৈনিক সংবাদ শিরোনাম দেয় : ‘জগন্নাথ হল মিলনায়তন ধসে ৫০ জন ছাত্র নিহত, আহত দুই শতাধিক। রক্তদানের আবেদন। ’ বাংলার বাণী সংবাদ ছাপে এই শিরোনামে : ‘জগন্নাথ হলের ছাদধসে ৫০ জন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু আহত ৩ শতাধিক। ’ কোনো পত্রিকা একে লেখে ‘জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি’ বলেও। তখনো আহত ও নিহতের সঠিক হিসাব না পাওয়ায় সংবাদ শিরোনামে ভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়।
পরে দেখা গেছে, মোট ৩৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহতের সংখ্যা শতাধিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন চিরতরে। এই দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় পনেরো ও সাতদলীয় ঐক্য জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা। বিদেশি কূটনীতকরাও শোক জ্ঞাপন করেন। তিন দিন জাতীয় শোক ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ১৬ অক্টোবর সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের আত্মীয়দের প্রতি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। সে বছর থেকেই ১৫ অক্টোবরকে ঘোষণা করা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’ হিসেবে।
Leave a reply