সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে এই ব-দ্বীপ অঞ্চল রক্ষার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ। শ্বাপদসংকুল এ অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে লাখ লাখ মানুষ। নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা এই বনজীবীদের কাছে আতঙ্কের নাম একেকটি দস্যুবাহিনী। সুখের কথা, এই দস্যুবাহিনীগুলো একে একে আত্মসমর্পণ করছে, আইনের কাছে নিজেদের সোপর্দ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ দস্যুবাহিনীর আত্মসমর্পণের নেপথ্যের গল্প জানাচ্ছেন তোয়াহা ফারুক।
কিছুদিন আগেও এরা একেকজন ছিলেন সুন্দরবনের ত্রাস। অস্ত্রের মুখে বনজীবীদের উপার্জনের ভাগ কেড়ে নেয়াই ছিল তাদের পেশা। সুন্দরবনের জলে-স্থলে কী এক আতঙ্কের জাল বিছিয়ে রেখেছিল এরা একেকজন! বলছি সুন্দরবনের বনদস্যুদের কথা। দাপুটে জীবন ছিল তাদের, কিন্তু ফেরারি সেই জীবনে শান্তি ছিল কী? জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের অর্থাৎ জঙ্গলের জীবনের প্রাকৃতিক সমস্যাগুলো তো মোকাবেলা করতেই হতো, পাশাপাশি দস্যু নিধনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল। এছাড়া দস্যুদলের আন্তঃসংঘাতের মতো নৈমিত্তিক বিষয়গুলো তো ছিলই। ফলে দস্যুদলগুলোর ভেতরে চাপা আতঙ্ক থাকার যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান ছিল।
উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ সুন্দরবন ও সাগরের উপর নির্ভরশীল। মাছ, শুঁটকি, মধু, গোলপাতা, কাঁকড়া ও কাঠ সংগ্রহ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। এই দস্যুদের কারণে বনজীবীরা ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। আর এর প্রভাব যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আক্রান্ত করছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে এই দস্যুদলকে থামাতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হলো। কিন্তু বাস্তবে সুন্দরবনের মতো দুগর্ম, শ্বাপদসংকুল জায়গায় চষে চষে দস্যুদল খুঁজে বের করা রীতিমতো দুরূহ। খড়ের গাঁদায় সুঁচ খোঁজাও যেন ঢের সহজ কাজ।
ঠিক এরকম একটা পরিস্থিতিতে একজন মানুষ বাতলে দিলের অদ্ভুত এক সমাধান! যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নিতে হবে না। বরং দস্যুদলই দুর্গম বন থেকে দলে দলে এসে অস্ত্র জমা দিয়ে যাবে। এও কী সম্ভব!
এতক্ষণে নিশ্চয় কারও বুঝতে বাকি নেই কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, তিনি মোহসীন-উল হাকিম। একজন সহজ মানুষ, তাই সমাধানটাও সহজে টানতে পারলেন। খোলা মন নিয়ে মানুষের সাথে মিশতে পারার সহজাত ক্ষমতার কারণেই কিনা সুন্দরবনের বনজীবীদের মাঝে তুমুল গ্রহণযোগ্যতা যমুনা টেলিভিশনের এই বিশেষ প্রতিবেদকের। আবার, শঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে গহীন অরণ্যে গিয়ে দস্যুদলকে জীবনের গল্প শোনাতেও এতটুকু ক্লান্তি নেই তার।
ঢাকা শহরের রমরমা সব ইস্যুর বদলে আপাতদৃষ্টিতে এমন নিরস একটা ইস্যুতে সময় নষ্ট করায় হয়তো অনেকেরই কথা শুনতে হয়েছিল। তারওপর জীবনের ঝুঁকি তো আছেই। যাদের ভয়ে মানুষ কাঁপে, অস্ত্রধারী সেই মানুষগুলোর সাথে কিনা তাদেরই আস্তানায় গিয়ে সাক্ষাৎ করা, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে উদ্ধুদ্ধ করা- এতো চাট্টিখানি কাজ নয়। সাংবাদিকের কর্মও নয়! তবে কেনো এ ঝুঁকি নেয়া?
উত্তরে মোহসীন-উল হাকিম জানালেন, আমি একজন সংবাদকর্মী, তারওআগে, আমি একজন মানুষ। আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হোক এটা সবাই চায়, আমি চেয়েছিলাম রক্তপাতহীন কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কাজটা হোক। এ ভাবনা থেকেই তাদের আত্মসমর্পণে উদ্ধুদ্ধ করার চেষ্টা। যমুনা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আমাকে সমর্থন দিয়েছিল। পাশাপাশি র্যাব-৮ এর কাছ থেকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস পাই।
তারপর- অমিতবেগে ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষটি। দস্যুদলের সাথে একবার কথা আগায় তো আবার দু’কদম পিছিয়ে যায়। বনদস্যুরা মানুষটিকে বিশ্বাস করলেও এটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না যে আবার তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। বিপরীতদিক থেকেও নানা দোলাচল ছিল, থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এমন ঘটনা যে আগে কখনো ঘটেনি। তাও আবার একজন সাংবাদিকের মধ্যস্থতায়!
সকল সংশয় ভোজবাজির মতো উবে গেল, বলা ভালো যেতে হলো। মোহসীন-উল হাকিমের মতোই কিছু করার তাগিদ নিয়ে এগিয়ে এলেন একজন মেজর। র্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক আদনান কবীর।
তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালের ৩১মে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি এলো। দুর্গম বন থেকে মোহসীন-উল হাকিমের হাত ধরে বের হয়ে আসলেন কুখ্যাত দস্যু কাদের মাস্টার। পেছনে একে একে আরও ৯ জন! ৫২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও সাড়ে ৫ হাজার রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দিলো মাস্টার বাহিনী।এরপর একবছরের কম সময়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে ১২টি দস্যুবাহিনীর ১৩২ জন সদস্য। স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।
এতগুলো বনদস্যুকে আত্মসমর্পণের নেপথ্যের গল্প করতে গিয়ে মেজর আদনানের ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন মোহসীন-উল হাকিম। জানালেন, মোংলার স্থানীয় সাংবাদিক নিজামউদ্দীনের আন্তরিক সহযোগিতার কথা। যমুনা টেলিভিশনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আহসান রাজীব ও বাগেরহাট প্রতিনিধি ইয়ামিন আলীর কথাও বলতে ভুললেন না। ক্যামেরা হাতে মোহসীন-উল হাকিমের সাথে শ্বাপদসংকুল বনে ঘুরে বেড়িয়েছেন যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন বায়েজীদ ইসলাম পলিন। ক্যামেরার মাধ্যমে যতটুকু তিনি দেখিয়েছেন, অনেকটুকুই আমরা দেখেছি। কিন্তু ক্যামেরার পেছনে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি সফলকাম করতে পলিন যেভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তা উল্লেখ করতে গিয়ে ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না মোহসীন-উল হাকিম।
সুন্দরবনের বনজীবীদের মনে এখন অনেকটাই স্বস্তি ফিরে এসেছে। আগের মতো আর মাছের ভাগ দিতে হয় না জেলেদের। তবে মোহসীন-উল হাকিম মনে করেন, সুন্দরবনকে পুরোপুরি দস্যুমুক্ত করতে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দস্যুবৃত্তিতার পেছনে যারা মদদ দিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন দস্যুবাহিনী গজিয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসন করাটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক। পাশাপাশি যেসকল দস্যুবাহিনী এরপরও আত্মসমর্পণ করেনি তাদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।
আত্মসমর্পণ পর্বের শুরুটা হয়েছিল যে কাদের মাস্টারকে দিয়ে তাকে দিয়েই ইতি টানা যাক।
একসময়ের দুর্ধর্ষ দস্যু কাদের মাস্টার এখন মুরগীর খামারি। স্ত্রী-কন্যাসহ সাদামাটা জীবন কাটাচ্ছেন- যে জীবন মানুষের। যেখানে আধপেটা খেয়ে থাকলেও নিশ্চিন্তে ঘুমানোর স্বর্গসুখ অনুভব করা যায়। অস্ত্রের মুখে কারও জীবিকা কেড়ে নেয়ার বদলে ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা অর্জনের তৃপ্তির যে ঝিলিক কাদের মাস্টারের চোখেমুখে তা টের পেতে বোদ্ধা হওয়া লাগে না, মোহসীন-উল হাকিম হলেই চলে।
যমুনা অনলাইন: টিএফ
Leave a reply