গাজীপুর সদর উপজেলার কিশরিতা এলাকায় ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রওজা হাইটেক নামের একটি কারখানায় আগুন লেগে ১০ শ্রমিক প্রাণ হারান। দু’জন গুরুতর দগ্ধ হন।
পরদিন নিহত এক শ্রমিকের বাবা বাদী হয়ে কারখানার পাঁচ মালিক ও দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই কারখানাটিতে লাক্সারি নামে ফ্যান তৈরি করা হতো।
এর তিন দিন আগে ১১ ডিসেম্বর বিকালে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দগ্ধ হয়ে আরও ১০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় নিহত একজনের ভাই বাদী হয়ে কারখানা মালিক নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। একতলা টিনশেড কারখানাটিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ওয়ান টাইম প্লেট, কাপসহ প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা হতো।
শুধু ওই দুটি কারখানাই নয়, অনুমোদনহীন বেশ কয়েকটি কারখানাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ীদের চিহ্নিত করা গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকার নবাব কাটারার ৪৩ নম্বর বাড়ির একটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে আগুনে ১২৫ জন প্রাণ হারান।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। ওই সময় পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
ভবনটিতে রাসায়নিক পদার্থ মজুদ ছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পর সংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, কর্তৃপক্ষের টনক হয়তো নড়বে। তবে তা হয়নি। এসব অগ্নিকাণ্ডের কয়েকটির ক্ষেত্রে শুধু মালিক বা কারখানার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে অনুমোদনহীন কারখানা কিভাবে চলল?
সে বিষয়ে প্রশাসন কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে ক’টি ঘটনায় মামলা হয়েছে- সেসব মামলায়ও সাজার কোনো নজির নেই। বরং মামলার পরপরই আসামিরা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবমতে, গত দুই দশকে শিল্প-কারখানায় ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। হতাহতের পক্ষ থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৭টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে মাত্র দুটি ঘটনায় মামলা হয়েছে।
এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা সব সময়ই থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে দায়িত্ব অবহেলার কারণে কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অতিসম্প্রতি গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জে পরপর দুটি অগ্নিকাণ্ডে মোট ৩২ জনের প্রাণহানির পর অবহেলাজনিত মৃত্যু এবং এর সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, কারখানা পরিদর্শন বিভাগসহ দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে।
জানতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, মালিকপক্ষের অবহেলার পাশাপাশি কারখানা পরিদর্শন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলায় অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে।
পাশাপাশি বাড়ছে শ্রমিকের প্রাণহানির সংখ্যা। কারখানা পরিদর্শকরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না। এমনকি কারখানাগুলোতে আইনের প্রয়োগও যথাযথ নেই।
শ্রমিক নেতা ও বিদেশি চাপের মুখে বর্তমানে কিছু কারখানায় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিক হত্যার বিচার হচ্ছে না। এ কারণে মালিকরা শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা করতে দ্বিধা করেন না। মালিকপক্ষের সচেতনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই অগ্নিকাণ্ডে হতাহত কমানো সম্ভব।
ভয়াবহ দুই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা ও বিচার : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে ‘তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের’ ঘটনায় প্রথম মামলা হয়।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে অন্তত ১১২ জন নিহত ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এতে তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ প্রতিষ্ঠানটির ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪(ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন আদালত।
এর পর থেকে দীর্ঘ সময়ে মোট ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এর মধ্যে দু’জন মালিকপক্ষে (আসামিপক্ষ) সাক্ষ্য দিয়েছেন। সর্বশেষ ৭ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল।
কিন্তু বরাবরের মতো ওই দিনও সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এজন্য ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত আগামী ২০ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার মোড়ে লাগা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দ্বিতীয় মামলাটি হয়। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। পরে হাসপাতালে মারা যান আরও চারজন।
ঘটনার পরদিন চকবাজারের বাসিন্দা মো. আসিফ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় যে প্রাইভেটকারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগে সেই কারের মালিক মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শাহীনের নাম উল্লেখ করে আরও ১০-১২ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
পরে পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চতুর্থতলার বসতবাড়ির বিভিন্ন ফ্লোর দাহ্যপদার্থ ক্রয়-বিক্রয়কারীদের কাছে আর্থিকভাবে লাভবানের আশায় ভাড়া দেন।
সেখানে ফ্যামিলি বাসা ভাড়া না দিয়ে আগুন লেগে মানুষের জান-মালের ক্ষতি হতে পারে জেনেও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেন। এ মামলায় গ্রেফতার হলে ৮ এপ্রিল মামলার দুই আসামি হাসান ও সোহেলের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে ১৬ এপ্রিল ওই দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বর্তমানে তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। মামলা দায়েরের ১০ মাস পার হলেও অদ্যাবধি তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়নি।
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply