মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার নিয়ামত আলী ১৮ শতক জমি উদ্ধারে মানিকগঞ্জ আদালতে মামলা করেন ১৯৬৯ সালে। তিনি মারা যাওয়ার পর ছেলে নজর আলী সেই মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিচারিক আদালত শেষ করে মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন।
জমিটি বুঝে পাওয়ার অপেক্ষা ৫০ বছরে ফুরোয়নি, কবে ফুরোবে জানেন না নজর আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদের ১৮ শতক জমি পেতে ১৯৬৯ সালে বাবা প্রথম মামলা করেন। পরে বাবা মারা গেলে আমি মামলা পরিচালনা করি। জজ আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেন। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইহোর্টে আপিল করে। নভেম্বরে হাইকোর্ট আমাদের পক্ষে রায় দেন। এখনও রায়ের কপি পাইনি।’
শুধু এ মামলা নয়, দেশের আদালতগুলোতে এখন প্রায় ৩৭ লাখ মামলা ঝুলছে। দেশের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। এক বছর আগে (২০১৮ সালের ডিসেম্বরে) এ সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। সে হিসাবে ১ বছরে বেড়েছে প্রায় এক লাখ মামলা।
মামলা বাড়লেও সে হারে বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দেশের প্রায় তিনশ’ আদালতে (সুপ্রিমকোর্ট ছাড়া) এখন বিচারক আছেন ১ হাজার ৮২০ জন। মামলাজট কমিয়ে আনতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা কমছে না। বরং প্রতিদিনই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। রায় যখন পাওয়া যায়, তখন আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি জোরদার করা দরকার। সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমাদের এ বছর লক্ষ্য থাকবে ৫ থেকে ৬ লাখ মামলা কমানো। আমরা সেভাবে আদালতের লোকবল বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আরও জোরদার করা হবে। বিষয়টি এখনও জনগণের কাছে তেমন পরিচিত নয়। সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা যেগুলো আপসযোগ্য, সেগুলো কোর্টের বাইরে মীমাংসা করতে আদালত যেন বলেন। এজন্য বিচারকদের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সুপ্রিমকোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মামলা ৩৬ লাখ ৪০ হাজার। ৩১ ডিসেম্বর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ লাখ ৬০ হাজারে। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৯০ হাজার ৮০০টি ও আপিল বিভাগে ২২ হাজার ৫৯৬টি মামলা বিচারাধীন। ঢাকার ৪০ আদালতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২১৮টি।
হাইকোর্টে এখন বিচারপতি রয়েছেন ৯৮ জন। এর মধ্যে তিনজনকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ৩৫টি দ্বৈত ও ১৯টি একক বেঞ্চে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে বিভিন্ন শ্রেণির (ফৌজদারি, দেওয়ানি ও রিট) মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২২ হাজার ৮২৫টি। আর আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ১০২টি।
সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান বলেন, মামলাজট কমাতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। গত বছরের শুরুতেই তিনি কয়েকটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন একেবারে পুরনো ফৌজদারি (বিবিধ) মামলাগুলোর শুনানির জন্য। প্রতি বৃহস্পতিবার পুরনো মামলাগুলো হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের কার্যতালিকায় (কজ লিস্ট) শুনানির জন্য রাখা হয়। পরে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করেন আদালত।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ৭ ডিসেম্বর জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আদালতের সময়ের ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ (আপস) করা হবে না। আদালতের সময় যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এখন থেকে কোনো সাক্ষী হাজিরা দিলে রাত ১০টা হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ করে তাকে ছাড়বেন।
মামলাজট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তি কমার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন, অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচার শেষ না হওয়ার আগেই বিচারককে বদলি করা হয়। নতুন বিচারকের মামলাটি বুঝতে সময় লাগে। অনেক মামলা আছে নতুন করে শুনানি করা হয়। এছাড়া মামলায় সাক্ষী না আসার কারণে অনেক সময় মামলা এগোতে পারে না। সময়মতো সাক্ষীকে উপস্থাপন না করায় বিচার সম্পন্ন হতে সময় লাগছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইলে বিচারক ও তাদের সহায়ক লোকবল বাড়াতে হবে, এর আগে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার।
জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী আরও বলেন, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। রায় যখন মেলে, তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না।
শফিক আহমেদ বলেন, মামলাজট কমাতে হলে সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
Leave a reply