আসামজুড়ে অতিরিক্ত ৬০ হাজার পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করেছে রাজ্য সরকার। হিন্দুস্তান টাইমস জানাচ্ছে, সেনাবাহিনীকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজন হলেই মাঠে নামবে তারা। এ থেকেই অনুমান করা যায় পরিস্থিতি কতটা উত্তপ্ত।
এমন অবস্থার সৃষ্টি মূলত একটি তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে। আসামের সংখ্যালঘু মুসলমানদের বড় একটি অংশকে ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’ মনে করে বর্তমান ভারত সরকার। আজ রোববার (৩১ ডিসেম্বর) তালিকা প্রকাশ করে জানানো হবে- রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে কারা ভারতের নাগরিক, আর কারা ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত হবেন।
কয়েকটি শর্ত যারা পূরণ করতে পারবেন তারা ছাড়া বাকি সবাইকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’র তালিকায় ফেলা হবে। এই ইস্যুটি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর নেতারা এত পরিমাণ রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন যে, এখন আর সেটি ‘অবৈধ অভিবাসী’ ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং এখন পরিণত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের পরিচয়ধারী মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্বে। ফলে বহু প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাস করা মুসলমানরাও আতঙ্কে আছেন তাদের নাম তালিকায় থাকে কীনা।
ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর ধারণা, জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা National Register of Citizens (এনআরসি) নামক ওই তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাওয়া মুসলমানের সংখ্যা ৫০ লাখের মতো হবে। অর্থাৎ, রোববার মধ্যরাত থেকে এরা ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’ হিসেবে গণ্য হবেন।
এদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সে ঘোষণা ইতোমধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিয়ে রেখেছে। আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এনআরসি তালিকায় যাদের নাম উঠবে না তাদেরকে (বাংলাদেশে) পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমরা আর সুযোগ দিতে চাই না। তাই নিরাপত্তার সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।’
মন্ত্রীর এমন মন্তব্যে মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক চরমে উঠেছে। অবশ্য ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতাদের মুখে এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তারা আসামে ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি হয় এমন মন্তব্য করে আসছেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর আসাম সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের’ তল্পি গুটানোর সময় হয়েছে।’
উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের এমন উস্কানি তৃণমূলে কতটা প্রভাব ফেলছে তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে গত বৃহস্পতিবার আসামের গোহাটিতে অনুষ্ঠিত একটি সমাবেশ। বিশ্ব হিন্দু সেনা’র আয়োজনে সেখানে সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক জি ডি কিরণ ভারতীয় একাধিক টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে ঘোষণা দেন, ৩১ ডিসেম্বরের পর আসামে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো হবে।
নিজের সংগঠনের নেতাকর্মীদের সামনে জি ডি কিরণ বলেন, “৩১ ডিসেম্বর এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর ৫/৭ দিন অপেক্ষা করবো। এর মধ্যে আরশাদ মাদানিকে (ভারতীয় আলেম) গ্রেফতার করা না হলে বিশ্ব হিন্দু সেনারা ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালাবে। গলিতে গলিতে ঢুকে সবজি কাটার দা-বটি যা পাওয়া যাবে নিয়ে হামলা করা হবে। সরকার ব্যবস্থা না নিলে আমরা আইন হাতে তুলে নেব, মার্ডার করবো।”
ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ জানাচ্ছে, উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে কিরণকে বৃহস্পতিবারই আটক করেছে আসামের পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে এমন মুসলিমবিদ্বেষী উস্কানি এখন আসামে নিয়মিত ঘটনা।
রাজ্যটির মুসলিম নেতাদের অভিযোগ, এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের এই বিতর্কিত তালিকাটি প্রকাশ করা হচ্ছে আসামের মুসলিমদেরকে রোহিঙ্গাদের মতো রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত করার জন্য।
১৯৫১ সালের পর আসামে প্রথম বারের মতো পরিচালিত এক জনগণনার ভিত্তিতে এই ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স’ তৈরি করা হয়েছে। রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মুসলিম; সংখ্যায় যা এক কোটিরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মুসলমানকে এনআরসি তালিকার বাইরে রাখা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে আসামের ‘নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতি ও কংগ্রেস নেতারা।
আসাম ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘সংবাদ প্রহরী’ জানাচ্ছে, “রাজ্যের নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতি এবং কংগ্রেসের নেতারা এক ভয়ানক ছবি তুলে ধরে অভিযোগ করেছে, রাজ্যে বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে চক্রান্ত করা হচ্ছে। প্রায় ৫০ লক্ষ হিন্দু-মসলিম মানুষের নাম এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাবে।”
নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির সম্পাদক প্রধান সাধন পুরকায়স্থ জানান, এনআরসিতে নাম তোলার যোগ্যতা হিসেবে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। প্রথম শর্ত— ১৯৫১ সালের এন আর সিতে নাম থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত— ১৯৭১ সালের ২৪মার্চের মধ্য রাত্রি পর্যন্ত যে কোনও ভোটার তালিকায় নাম থাকা আবশ্যক। উল্লিখিত এই দুই শর্ত পূরণ করা ব্যক্তিরা তাদের বংশধরের যোগসূত্র থাকতে হবে।”
কিন্তু বাস্তবে এসব শর্ত পূরণ করেও তালিকায় থাকতে পারবেন না অনেকে। এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রধান পুরকায়স্থ ‘সংবাদ প্রহরী’কে বলেছেন, তালিকার নামে আসলে নাটক হচ্ছে।
এদিকে বিতর্কিত তালিকা প্রকাশের আগমূহুর্তে আসামজুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। প্রশাসনের ধারণা, তালিকা প্রকাশের পর বেগতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। চারিদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে থমথমে আসাম। রাজ্যটির তিন কোটি মানুষ প্রহরণ গুনছেন রোববার মধ্যরাতে কী ঘটে তার অপেক্ষায়।
Leave a reply