পঙ্গপালে খাচ্ছে মানুষের খাবার

|

ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে ছোট ছোট পতঙ্গের পাল। এসেই ছেয়ে ফেলছে মাঠ-ঘাট-আঙিনা। খেয়ে সাবাড় করে ফেলছে মাঠের পর মাঠ কৃষকের অতি কষ্টের ফসল। শুধু ফসলই নয়, চুষে খাচ্ছে ছোটবড় গাছের পাতা। খাওয়া শেষ হলেই উড়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোনো মাঠে। আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এশিয়ার দেশগুলো পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ঝাঁকবদ্ধ এই মরু পতঙ্গের দল। এর তীব্র আক্রমণে সোমালিয়ায় সম্প্রতি জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ও ইথিওপিয়ায় ফসলের ক্ষেত থেকে পঙ্গপাল তাড়াতে স্থানীয়রা বন্দুক, টিয়ারগ্যাস ও সাইরেন ব্যবহার করছে। বিপাকে পড়েছে পাকিস্তান। ইতিমধ্যে সেখানেও ঘোষণা করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ঢুকে পড়েছে পতঙ্গটি। দেশটির অন্তত তিনটি রাজ্যে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জাতিসংঘের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে- ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, জিবুতি ও ইরিত্রিয়ায় কোটি কোটি মানুষের খাবার খেয়ে ফেলছে এই পঙ্গপাল। এতে খাদ্য নিরাপত্তায় ভয়াবহ হুমকি তৈরি হয়েছে। তৈরি হতে পারে দুর্ভিক্ষের মতো মানবিক সংকট।

পঙ্গ মূলত ঝিঁঝিঁপোকার মতো দেখতে এক ধরনের ছোট পতঙ্গ। এটি আর্কিডিডি পরিবারের ছোট শিংয়ের বিশেষ প্রজাতি যাদের জীবনচক্রে দল বা ঝাঁক বাঁধার বৈশিষ্ট্য থাকে। এই পতঙ্গগুলো সাধারণত একা থাকে। তবে বিশেষ অবস্থায় তারা একত্রে জড়ো হয়। পঙ্গপাল প্রধানত আধা শুকনো ও আধা-মরুভূমি আবহাওয়ায় থাকে। এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অকালবৃষ্টি এবং বার বার সাইক্লোনের জন্য এদের বাড়-বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মরু দেশগুলোতে বছরে বৃষ্টিপাত হয় আট ইঞ্চিরও কম। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ তথা পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০০ সেমি. বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে মরু অঞ্চলে এ অতি বৃষ্টির কারণে পঙ্গপালের ব্যাপক বংশবিস্তার ঘটেছে। কয়েক মাসের মধ্যে দুটি মহাদেশ মিলিয়ে ৬০টি দেশে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে কৃষি থেকে শুরু করে দেশগুলোর সামগ্রিক অবস্থার ওপরই প্রভাব পড়ছে। কয়েক মাস আগে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে লাখ লাখ একর জমিতে হানা দেয় পঙ্গপাল। কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। সেই সঙ্গে আফ্রিকার আরও ১৪টি দেশেও ছড়িয়েছে এই পতঙ্গ। লোহিত সাগরের দুই পাড়েও সমানতালে বাড়ছে এদের আধিপত্য। সুদান, মিসরের উপকূল থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিম সৌদি আরবেও চলছে বংশবিস্তার। ওমানের পূর্ব উপকূল থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তান পর্যন্ত পৌঁছেছে তারা।

সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মহামারী আকার নিয়েছে এটা। আর কেনিয়াতে ৭০ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির ৭০ হাজার হেক্টর জমি এখন পঙ্গপালের দখলে। কেনিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ‘কীটনাশক ছিটিয়ে আমরা এ পর্যন্ত বিশ ঝাঁক পঙ্গপাল মেরেছি। আরও কোটি কোটি পোকা আসছে।’ জাতিসংঘের মতে, প্রতি পঙ্গপালের ঝাঁকে থাকে ১৫ কোটিরও বেশি পতঙ্গ। একটি ঝাঁক এক বর্গকিলোমিটার এলাকা বা ২৫০টি ফুটবল মাঠের সমান জায়গা দখল করে থাকে।

পূর্ব আফ্রিকাজুড়ে এই মরু পতঙ্গের আক্রমণে জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে। দ্য হর্ন অব আফ্রিকার ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, জিবুতি ও সোমালিয়া নিয়ে গঠিত ওই অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকা চরম হুমকির মুখে। ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া থেকে এটা এখন কেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম, উগান্ডার উত্তর-পূর্বের ২০০ কিলোমিটার ও দক্ষিণ সুদানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দিকে হানা দিচ্ছে। আফ্রিকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ৭ কোটি ডলারের অনুদান চেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। সংস্থাটির প্রধান মার্ক লোকক বলেন, আফ্রিকায় এই ভয়াবহ পঙ্গপাল উদ্বেগজনক হারে ফসল ধ্বংস করছে। ইতিমধ্যেই খাদ্য স্বল্পতায় থাকা পরিবারগুলো তাই আরও বিপাকে পড়েছে। ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো ব্যাপক আকারে পঙ্গপালের আক্রমণের মুখে পড়ে পাকিস্তান। সম্প্রতি ২০১৯ সালের মার্চে পাকিস্তানে ফের পঙ্গপালের আক্রমণ শুরু হয়। এটি সিন্ধু, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের ৯ লাখ হেক্টর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোটি কোটি রুপি মূল্যের ফসল ও গাছপালা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশটির সরকার জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শুক্রবার এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেন।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply