জন ফোর্ডের বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন মুভি ‘দ্য ম্যান হু শট লিবার্টি ভ্যালান্স’ এর দারুণ জনপ্রিয় উক্তি। তবে বুনো পশ্চিম নয়, আধুনিক বিশ্বেই যেন সত্যের চেয়ে বানিয়ে বলা গল্পটা বেশি প্রচলিত, সমাদৃত। তবে গুজবকে মাথায় তুলে নিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারটাকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখানেই আবির্ভাব গত শতাব্দীর অন্যতম বিষ্ময়কর চরিত্র জর্জ পি বার্ডেলের।
ঘটনার শুরু ১৯২৭ সালে। জর্জিয়া টেকে সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন উইলিয়াম এডগার স্মিথ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে ভুল করে দুইটা ভর্তি ফরম দেয়। দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায় স্মিথের মাথায়। ঠিক করে বাড়তি ফর্মটা দিয়ে আরেকবার ভর্তি হবে, ভুয়া নামে। জন্ম হয় জর্জ পি বার্ডেলের। খেয়ালের বশে এমনটা করলেও জর্জ চরিত্রটিকে প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট সময় ও শ্রম দেন স্মিথ। ক্লাসে নাম ডাকা হলে নিজেই সাড়া দিতেন। এমনকি বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে হোমওয়ার্কও দুবার করে প্রস্তুত করেছেন। শিক্ষক যাতে ধরতে না পারে, সেজন্য দ্বিতীয়টা একটু এদিক সেদিক করে দিতেন। পরীক্ষার পালা এলে দু বার করে দুই নামে পরীক্ষা দিয়েছেন। এভাবে ১৯৩০ সালে স্মিথের সাথে সাথে বার্ডেলও জর্জিয়া টেক থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রিলাভ করে। ক’ বছর পরে স্নাতোকত্তোর ডিগ্রিও জুটে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালমনির অফিসিয়াল তালিকাতেও উঠে যায় তার নাম।
এডগার স্মিথের এই কীর্তির খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাদের মধ্যেই কোন উৎসাহীর উদ্যোগে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খাতায় নাম ওঠে জর্জ বার্ডেলের। কয়েক বছর পর শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেখানেও দেখা যায়, একাধিক ফ্রন্টে লড়ছে জর্জ পি বার্ডেল নামের এক সৈনিক। মার্কিন বিমান বাহিনীর অষ্টম বহরের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে বোমারু বিমানে করে ৮ দফা অভিযানে অংশ নিয়েছেন যে বৈমানিক তার নাম জর্জ বার্ডেল। পরে জর্জিয়া টেকের এক সাবেক শিক্ষার্থী ওই ইউনিটের প্রধান হয়ে এলে বুঝতে পারেন কারসাজিটা।
১৯৫৮ সালে আটলান্টিক জার্নাল কন্সটিটিউশনে ছাপা হয়, বিয়ে করছেন জর্জ বার্ডেল। পাত্রী অ্যাগনেস স্কট কলেজের রামোনা কার্টরাইট। বলা বাহুল্য বার্ডেলের মতো রামোনা বলেও কেউ নেই। সেটা অ্যাগনেস স্কট কলেজেরই কারোর কারসাজি। তবে মজার ব্যাপার হলো ২০০৬ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর বার্ডেল-রামোনা দম্পতির বিবাহের ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে আলোচনা হয় একটি লাইভ রেডিও শোতে।
গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৯৬৯ সালে জর্জিয়া টেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ক্লাস রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু হয়। কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিলো, এবার হয়তো বার্ডেলের নামে রেজিস্ট্রেশনের প্রবণতা রোখা যাবে। কিন্তু কীসে কী! দেখা গেলো, হ্যাকাররা কম্পিউটার সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে বলতে গেলে প্রতিটা ক্লাসেই একজন জর্জ বার্ডেল ভর্তি করে রেখেছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই হাল ছেড়ে দেয়।
১৯৬৯ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত জর্জ বার্ডেলের নাম ছিলো জনপ্রিয় স্যাটায়ার ম্যাগাজিন ‘ম্যাডে’র প্রকাশক মণ্ডলীর তালিকায়। ২০০১ সালে টাইম ম্যাগাজিন যখন পারসন অফ দ্য নির্বাচনে জরিপ চালাচ্ছে, তখন একটা পর্যায়ে দেখা যায় ৫৭ শতাংশ ভোট নিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে যিনি, তিনি আর কেউ নন, জর্জ পি বার্ডেল। তার ইতিহাস জানতে পেরে টাইম বার্ডেলকে অযোগ্য ঘোষণা করে। এরমধ্যে বার্ডেল কখনও জর্জিয়ার রেডিও স্টেশনের কর্মী হয়েছেন, অল্টারনেটিভ রক ব্যান্ডের অ্যালবামে তার নাম উঠেছে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে, এমনকি ২০০০ সালে নির্বাচনের আগে জর্জিয়ায় ডেমোক্র্যাটিক নাশনাল কনভেনশনে প্রতিনিধি হিসেবেও তার নাম রাখা হয়। জর্জিয়া টেকে বার্ডেলের শিক্ষাজীবন এখনও চলছে, ওদিকে ভক্ত অনুরাগীদের কল্যাণে বেশ কয়েক দফায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন ছেলে জর্জ বার্ডেল জুনিয়র।
২০১৫ সালের মার্চে জর্জিয়া টেক ক্যাম্পাসে দেয়া বক্তৃতা দেয়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মজা করে বলেন, তিনি আশা করেছিলেন, জর্জ বার্ডেল উপস্থিত থেকে তাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তার সাথে সাক্ষাতই হলো না।
সময়ের সাথে সাথে জর্জ বার্ডেল জর্জিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকনে পরিণত হয়েছেন। তিনি যেন এখানকার অবিনশ্বর কিংবদন্তী। নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা সবার আগের পরিচিত হয় বার্ডেলের গৌরবময় ইতিহাসের সাথে। অবস্থা এখন এমনই যে জর্জিয়া রাজ্যে যদি কেউ কারো আসল নাম বলতে না চায়, ব্যাবহার করে বার্ডেলের নাম। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও শেষ পর্যন্ত তার সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে ক্যাম্পাসে তার নামে একটি দোকান খুলে।
Leave a reply