কত সংগঠনের নামই তো শুনেছেন, কিন্তু মৃতদের সংগঠনের নাম কখনও শুনেছেন? না, বাচ্চাদের হ্যালোইন উৎসবকে ঘিরে কিংবা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বিত্তশালী কোনো অভিভাবকের সন্তানদের কম্ম এটি নয়। এটি অত্যন্ত দারিদ্র পীড়িত ও জীবন ধারণ সংকুল একটি অঞ্চলের সত্যি ঘটনা।
ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন লাল বিহারী, কিন্তু পাননি। ঋণ শোধে অক্ষম, বিষয়টি এমন নয়। ঋণ পাবেন না, কারণ তিনি মৃত। অনন্ত সরকারি অফিসের লেখপালকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারেননি যে লাল বিহারী জীবিত; তার সামনে দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত ভারতীয় আমলাতন্ত্র!
সরকারি লাল ফিতার বাঁধা খাতার মৃত লাল বিহারীর বাস ভারতের উত্তর প্রদেশের পূর্ব প্রান্ত আযমগড় জেলায়। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৫ সালে। আযমগড় এমন এক এলাকা যেখানে ৮০০ টাকারও কমে একজন খুনী ভাড়া করা যায়। হাতের পাঁচ এক চিলতে পরিমাণ জমি থেকেও হরহামেশাই উচ্ছেদ হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি জমির সংকট ও সুশাসনের অভাব- এ দুই পর্যবেক্ষণ থেকেই অনুমেয় জীবন ধারণ কতটা কঠিন ওই এলাকাতে।
স্বজনরাই একে অপরের বিরুদ্ধে করছেন ঘৃণ্য সব কাজ। ভয়াবহ জমির সংকটে ওই এলাকার মানুষেরা এক অদ্ভুত ও চাতুর্যপূর্ণ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়ে থাকে। পকেটে কিছু টাকা নিয়ে চলে যায় স্থানীয় ভূমি নিবন্ধন দপ্তরে, সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে নিজের পরিবারের কোনো জীবিত মানুষের নাম তুলে দেয় মৃতদের তালিকায়। এতে কি লাভ? এতে লাভ হয় জমি, উত্তরাধিকার সূত্রে।
এমনই এক ঘটানার শিকার লাল বিহারী। তার চাচা এক একর জমির লোভে সরকারি লোকদের দুই হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করিয়েছিল। দীর্ঘ ১৯ বছর নানা রকমের আন্দোলন ও সংগ্রাম, এমনকি অপরাধমূলক কাজ করে নিজেকে জীবিত প্রমাণ করেছে লাল বিহারী।
নানা জায়গায় ধরণা দিয়েও যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। লাল বিহারীর আইন পরামর্শক তাকে জানায়, এ ধরনের ঘটনা উত্তর প্রদেশে হরহামেশাই ঘটছে। লাল বিহারী এ ধরনের লোকদের খুঁজে বের করে একসাথে করলেন। গড়ে তুললেন উত্তর প্রদেশ মৃত সংঘ।
এ সময় সে নিজের নামের শেষে ‘মৃত’ শব্দটি করতে শুরু করে। এছাড়া, চাচার ছেলেকে অপহরণ করা, খুনের হুমকি, বিচারকদের অপমান করা, আইনপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা সম্বলিত প্রচারপত্র রাজ্যে সংসদে বিতরণ করা, এবং এমনকি সে স্ত্রীর জন্য বিধবা ভাতারও আবেদনসহ নানা রকমভাবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সবার মনোযোগ আর্কষণে তিনি সাধারণ নির্বাচনে ভারতের দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও ভি পি সিংয়ের বিপক্ষে প্রার্থীও হয়েছিলেন। এ সব কাজে প্রতিবারই সে হয় পুলিশের বেদম পিটুনি খেয়েছে, না হয় সরকারি লোকদের গালাগাল।
উত্তর প্রদেশ মৃত সংঘের ধারাবাহিক আন্দোলনে অবশেষে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের, তাও দীর্ঘ ১৯ বছর! নাকি মৃত সংঘের আন্দোলনে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা? যাই হোক, ১৯৯৪ সালে সরকার বিষয়টি সুরাহার উদ্যোগ নিয়েছিল। সংস্কার করা হয়েছিল সরকারি ভূমি নিবন্ধন দপ্তরের মৃতদের তালিকা। সরকারি কাগজে কলমে লাল বিহারী আবারও জীবিত হলেন।
দীর্ঘ সময় ধরে নানাবিধ নিপীড়ন সহ্য করতে হলেও তিনি এ আন্দোলনের সাফল্যে বেশ খুশি। উপভোগও করছেন বেশ। তার বক্তব্যই তা বলে দিচ্ছে:
“আগে আমলারা ভুত দেখলে ভয় পেত, এখন তারা মৃত সংঘের সদস্যদের ভয় পায়।”
তিনি আরও বলেন, “এ আন্দোলনে মধ্য দিয়ে আমার নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি মৃতদের আন্দোলনের নেতায় পরিণত হয়েছি।”
এভাবেই গড়ে উঠেছে জীবিত হয়েও সরকারি কাগজে-কলমে মৃত ব্যাক্তিদের সংগঠন উত্তর প্রদেশ মৃত সংঘের। এতকিছুর পরও থেমে নেই আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ন; থেমে নেই মৃত সংঘের কাজও।
লাল বিহারীর ভাষায়, “আমি জানি আমাকে এখনই হয়তো আরেক মৃত ব্যাক্তিকে সহায়তা করতে হবে।”
Leave a reply