মানজুর মোরশেদ:
২০১৯ সালের শেষ দিনে মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। একদম দেরি করেনি চীনা কর্তৃপক্ষ, দ্রুত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ডব্লিউএইচও-কে জানায় তারা। ১১ জানুয়ারি প্রথম একজন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই শুরু। আর এখন ৭৭ দিন পর সেই সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার, আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লাখের ওপর, আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চলের সংখ্যা ১৯৯! অর্থাৎ পৃথিবীর আর কোনো প্রান্তই বাদ নেই!
আমাদের দেশ ঘনবসতিপূর্ণ তাই শঙ্কাও বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ শহর বা দেশে কী বিপর্যয় হয়, সেটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ উহান এবং নিউইয়র্ক। চীনকে ছাড়িয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত মানুষের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। গড় হিসেবে বিশ্বে করোনা আক্রান্ত প্রতি ছয়জনের একজন যুক্তরাষ্ট্রে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে সারাবিশ্বে ১২ করোনা রোগীর একজন নিউ ইয়র্কের। প্রায় ১ কোটি মানুষের শহরটিতে করোনা রোগটির সংখ্যা বাড়ছে হু-হু করে। অনেকের আশঙ্কা সেটি ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। মূলত, আন্তর্জাতিক চলাচলের গেটওয়ে নিউ ইয়র্কের কেনেডি বিমানবন্দর, সারাবিশ্ব থেকে আসা যাত্রীরাই শহরটিতে ছড়িয়েছে এই মরণঘাতী ভাইরাস- সেটি এখন দিবালোকের মতো পরিস্কার।
এবার আসি উহান শহরে প্রসঙ্গে। এই শহরের জনঘনত্ব ও সংখ্যা নিউ ইয়র্কের চেয়েও বেশি। চীনে করোনা পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় অনেক শহর এবং প্রদেশ থেকে লকডাউন তুলে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু করোনার জন্মভূমি হুবেই প্রদেশ এবং উহান শহর এখনো লকডাউনের কবলে। গত দু-তিন দিন সেই অর্থে কোনো করোনা সংক্রমিত রোগীর সন্ধান ছিল না দেশটিতে, কিন্তু শনিবার হঠাৎ করে জনা পঞ্চাশেক নতুন রোগীর সন্ধান মিলেছে। আবারো লকডাউন কঠোর করতে মাঠে নেমেছে সেখানকার স্থানীয় পুলিশ। হুবেই ছেড়ে পাশের রাজ্য জিয়াংশুতে পলায়নপর মানুষের সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে পুলিশ। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পরও তারা এখনো কোয়ারেন্টাইনের ব্যাপারে খুব সচেতন। কিন্তু এর মধ্যেই আবার অবনতি। এত তৎপর হয়েও উহান ও নিউইয়র্কের মতো দুটি আধুনিক শহর করোনা মোকাবেলায় বিপর্যস্ত, হিমশিম খাচ্ছে; মৃত্যুপুরীর দু’টি খণ্ডচিত্র যেন!
আমাদের প্রাণের শহর রাজধানী ঢাকার জন্য ঐ দুই শহরের পরিণতি কি একটি বড় শিক্ষা নয়? দেড় কোটি মানুষের শহর ও আশপাশের আরও অর্ধকোটি মানুষের জন্য ১০টি হাসপাতাল ও করোনা শনাক্তকরণ কেন্দ্রের কথা বলছে সরকার। কিন্তু সেগুলো যে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় তার প্রমাণ দৈনিক টেস্টের হার! সরকারের রোগতত্ত্ব, ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর দৈনিক টেস্টের পরিমাণ সম্পর্কে সে অর্থে কোনো তথ্যই দিচ্ছে না! অথচ তাইওয়ান-দক্ষিণ কোরিয়া করোনা সংক্রমণ রোধে সাফল্য পেয়েছে করোনা টেস্টের হার বাড়িয়ে।
সরকারের অঘোষিত লকডাউন ঘোষণার পর যারা এই শহর ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন, তারা কি সারা দেশকে সংক্রমিত করার জন্য হুমকি নয়? এই লোকগুলোই পরিস্থিতি যেরকমই হোক না কেন, যখনই আবারও ঢাকায় ফিরবেন ঢাকার জন্য হুমকি হবেন না? তারও আগে যারা বিদেশ ফেরত, ঠিকভাবে কোয়ারেনটাইন কিংবা আইসোলেশন করেননি তারাও কি হুমকি হয়ে থাকছেন না?
আমরা চীনের উহান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক হতে চাই না! ঢাকা বাঁচলে বাংলাদেশ বড় অনুপ্রেরণা পাবে, পুরো দেশের রক্ষাকবচ হয়ে থাকবে। আসুন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগে ঢাকাকে প্রস্তুত রাখি। এখনও শেষ হয়ে যায়নি সময়, কারণ এদেশে এখনও মহামারি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি।
করোনা যুদ্ধে নিম্ন-মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ ও তার রাজধানী ঢাকা হোক, বাকি বিশ্বের জন্য রোল মডেল।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টিভি।
Leave a reply