করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ আছে পরীক্ষার জন্য এমন মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। টেলিফোনে দেয়া ঠিকানা ও ফোন নম্বর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়েও তাদের অধিকাংশের খোঁজ মিলছে না। তারা ভয়ে আত্মগোপন করেছেন। কাজেই তাদের সন্ধান পেতে হিমশিম খাচ্ছেন পুলিশসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা।
এরা বিভিন্ন সময় নিজের শরীরের লক্ষণ এবং উপসর্গ জানিয়ে টেলিফোন করেছেন আইইডিসিআরসহ সংশ্লিষ্ট স্থানে। এখন পরীক্ষার জন্য তাদের খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় দেয়া ঠিকানায় গিয়ে তাদের বেশির ভাগেরই সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন নম্বরও বন্ধ। কিছু মোবাইল ফোনে রিং হলেও সারা মিলছে না।
অথচ সরকার সন্দেহভাজন সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে সারা দেশে ২৯টি পিসিআর ল্যাব স্থাপন করছে। আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে সব কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন ল্যাবে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুত আছে সাতটি ল্যাব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার সক্ষমতা অনুযায়ী দেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পালিয়ে গেলে বা আত্মগোপনে থাকলে রোগী শনাক্ত করা যাবে না। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই মহামারীর প্রতিরোধ অসম্ভব হয়ে পড়বে। কাজেই স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ল্যাব বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের হাসপাতালগুলোত ইতোমধ্যে তিন লাখ ২৫ হাজার পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পাঠানো হয়েছে। রাজধানীতে কুয়েতমৈত্রী হাসপাতালের পাশাপাশি কুর্মিটোলা হাসপাতালকে সম্পূর্ণরূপে করোনা চিকিৎসায় প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং জেলা হাসপাতালে করোনা ইউনিট করা হয়েছে। কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল ও শেখ রাসেল ইন্সটিটিউট অব ডাইজেস্টিভ ডিজিজেজ হাসপাতালে মোট ২৪টি ভেন্টিলেশন মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে আইসিইউ শয্যা।
৩৯তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্য থেকে ১০ জন করে প্রতি জেলায় নিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সন্দেহজনক করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহে ৮০০ মাঠকর্মীকে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এত আয়োজনের পরেও রোগী শনাক্ত করতে না পারাটা হবে ব্যর্থতা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সোমবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে বলেন, এতদিন দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে যথেষ্ট পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তাই ল্যাবের সংখা বাড়ানো হচ্ছে। এখন সন্দেহজনক রোগীদের যথাস্থানে পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেকের ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, এমনকি বাড়িতে গিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতদিন যারা দেশে প্রবেশ করেছেন, ফোনে যোগাযোগ করেছেন পরীক্ষায় তাদের সহযোগিতা না পেলে আমরা দৈবচয়নের মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু করব। যাতে করে একজন সন্দেহজনক রোগীও বাদ না পড়ে।
অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগামী ৫ এপ্রিলের মধ্যে সব বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা শুরু হবে এবং আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে সারা দেশে ২৯টি পিসিআর ল্যাব পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকবে। তিনি বলেন, ল্যাবের পাশাপাশি আমরা কর্মী সক্ষমতা বাড়িয়েছি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নিয়াগপ্রাপ্ত সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসাররা (এসএমও) সন্দেহজনক কেস শনাক্ত করে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেবেন। ২৯তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্য থেকে ১০ জন করে ডাক্তার প্রতি জেলায় পদায়ন চলছে। যারা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি এবং কন্ট্রাক ট্রেসিংয়ে কাজ করবেন। এছাড়া স্যাম্পল কালেকশনের জন্য ইপিআই কর্মী নিয়োগ যুক্ত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বিত কন্ট্রোলরুমের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পথে ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৯৫৪ জন দেশে প্রবেশ করেছেন। এছাড়া এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আইইডিসিআর’র হট নম্বরগুলোতে ফোন কল এসেছে ৯ লাখ ৫২ হাজার ৫৭৮ জন। এর মধ্যে আইইডিসিআর-এ ফোন করেছে ৭৭ হাজার ১৬৯ জন। অথচ এ পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ৭৬ জনের। এ পর্যন্ত অনলাইনে ৯ হাজার ৬৯৫ জন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
নমুনা সংগ্রহ ও পরিবহন ১৯০টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। করোনা চিকিৎসায় ১০টি হাসপাতালকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ছয়টি এবং বেসরকারি চারটি। এগুলো হল- কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, মহানগর হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, সাজেদা ফাউন্ডেশন, রিজেন্ট হাসপাতাল (উত্তরা, মিরপুর), ইউনাইটেড হাসপাতাল (মুন্সীগঞ্জ), আকিজ গ্রুপ।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে আইইডিসিআরের পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস-বিআইটিআইডি, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইইডিসিআরের ফিল্ড ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে রাজধানীর আইসিডিডিআর-বি, আইদেশি যুক্ত হয়েছে।
দুই-এক দিনের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আর্মড ফোর্সেস ইন্সটিটিউট অব প্যাথলজি। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পথে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পিসিআর টেস্টের জন্য ইতোমধ্যে ৯২ হাজার টেস্ট কিটস সংগ্রহ করেছে। বিভিন্ন পিসিআর সেন্টারে ২০ হাজার কিট বিতরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে এখনও ৭২ হাজার টেস্ট কিট রয়েছে। ইতোমধ্যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৭৩০ জন চিকিৎসক ও ৪৩ জন নার্সকে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসা পদ্ধতির বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাপিচ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, সন্দেহজনকদের শনাক্ত করা কঠিন নয়। কারণ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করলেই সাসপেক্টেড কেস শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
Leave a reply