করোনামুক্ত বিশ্বে ফিরে যেতে ভ্যাকসিন নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০০টির মত ভ্যাকসিন তৈরীর প্রচেষ্টা চলছে। এজন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও প্রাইভেট ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। কিন্তু মূল কথাটি হচ্ছে ভ্যাকসিন মোটেও অন্যান্য ঔষধের মত নয়। ভ্যাকসিন যেমন রোগ প্রতিরোধ করতে পারতে আবার গুনগতমানহীন ভ্যাকসিন গ্রহণে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে জীবন হারাতে পারে। এজন্য ভ্যাকসিনের গুনগতমান বা সেইফটি সবচেয়ে বিবেচ্য বিষয়। ভ্যাকসিনের সেইফটি নিশ্চিত করতে অনেক সময় লাগে, যার কারণে বাজারে আসতে ১০ বছর পর্যন্তও লেগে যেতে পারে। ইতিপূর্বে শুধুমাত্র নিরাপত্তা ইস্যুতে অনেক ভ্যাকসিন প্রচেষ্টা বিশ্বে ব্যর্থ হয়েছে।
গত আগস্ট মাসের ২১ তারিখে দেশের ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার এবং ২২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকা আইসিডিডিআর’বি এর নির্বাহী পরিচালক এবং বেশ কয়েকজন সিনিয়র বিজ্ঞানী একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। প্রকাশিত বিবৃতিতে আইসিডিডিআর’বি সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের সেইফটি নিয়ে তাদের সন্দেহ নেই উল্লেখ করে এর মাত্রাতিরিক্ত গুণকীর্তন করে এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের এই ভ্যাকসিনের সেইফটি এবং কার্যকারিতা প্রশ্নে বিজ্ঞানভিত্তিক মতবাদকে মিডিয়া প্রকাশিত গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। আইসিডিডিআর’বি এর মত সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানের এমন আচরণে অনেক বিশেষজ্ঞ রীতিমত হতবাক।
কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা তা হলো, এখন পর্যন্ত যতগুলো করোনা ভ্যাকসিন ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পৌঁছেছে সেগুলোর কোনটি বিবেচনা না করে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনকে কেন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বলে বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে চাচ্ছে তার ব্যাখ্যায় যাননি আইসিডিডিআর’বি এর বিজ্ঞানীরা।
মনে রাখা দরকার যে, চায়নার এই ভ্যাকসিন দেশে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিতে সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানি লিমিটেড (এটি চায়নিজ সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান নয়) সম্প্রতি আইসিডিডিআর’বি এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এখানে আইসিডিডিআর’বি একটি চুক্তিবদ্ধ রিসার্চ অর্গানাইজেশন হিসেবে কাজ করবে।
আইসিডিডিআর’বি এর পক্ষ থেকে এমন একটি বিবৃতি দেখে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ এই সংস্থাটির সিংহভাগ অর্থায়ন হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে। অতীতেও আইসিডিডিআর’বি তে কলেরাসহ অন্যান্য অনেক ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। অতীতের ট্রায়ালগুলোতে বাংলাদেশের হাজারো সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হয়েছে তা সত্যি প্রশ্নবিদ্ধ। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সিনোভ্যাক আইসিডিডিআর’বি কে অর্থায়ন করবে এবং সেই হিসেবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পেতেই আইসিডিডিআর’বি এ ধরনের একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
আইইডিসিআর এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রথম করোনা ধরা পড়ে মার্চ মাসের ৮ তারিখ। অর্থাৎ, উহানে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেবার ৩ মাস পর। ঐ তিন মাস সময়ে সরকার বা সাধারণ মানুষের এই করোনা সংক্রমণ রোধে করণীয় সম্পর্কিত কোনও সচেতনতামূলক বিবৃতি আইসিডিডিআর’বি প্রকাশ করেনি। এই ধরনের একটি গবেষণা সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং তার বিজ্ঞানীদের থেকে প্রতিটি দেশ তেমনি আশা করে। অন্যান্য দেশে এটা হলেও বাংলাদেশের আইসিডিডিআর’বি এর তেমন কোনও সাড়া শব্দ ছিলো না। সারা দেশের মানুষ যখন করোনা টেস্ট নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখনো করোনা রোগ নির্ণয়ের জন্য আইসিডিডিআর’বি টেস্ট শুরু করেছে জুন মাসের শেষের দিকে যা সত্যি হতাশার।
দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশে সরকারি হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত হলো এবং প্রায় ৪ হাজার মানুষ করোনায় মারা গেলো কিন্তু আইসিডিডিআর’বি দেশের সাধারণ মানুষের সাহায্যার্থে একটি আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত করার চিন্তা করেনি। তাছাড়া আইসিডিডিআর’বি বাংলাদেশের করোনা রোগীদের নিয়ে একটি গবেষণাও প্রকাশ করেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাকসিন এর ট্রায়ালের জন্যই অপেক্ষা করছিলো এবং সংগত কারণেই তাদের উৎসাহ বেশি থাকার কথা।
এখন পর্যন্ত যতগুলো করোনা ভ্যাকসিন ফেজ-৩ ট্রায়ালে পৌঁছেছে তার মধ্যে ২ টি এমআরএনএ ভ্যাকসিন (মডার্না/এনআইএইচ এর এমআরএনএ-১২৭৩, ফাইজার/বায়োএনটেকের বিএনটি১৬২বি১), ২ টি এডিনোভাইরাস ভেক্টর দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন (অক্সফোর্ড এর চেডক্স১ এনকভ-১৯, চীনের ক্যানসিনো বায়টেক এর এড৫-কোভিড-১৯) এবং ৩ টি নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন (চীনের সিনো ফার্ম কোম্পানির ২ টি এবং সিনোভ্যাক কোম্পানির ১টি)। এখন এগুলোর মধ্যে কোনটি বাংলাদেশ ট্রায়াল করবে তা একমাত্র গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত।
আইসিডিডিআর’বি এর বিবৃতিতে বলা হলো, সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিন বানরের করোনা প্রতিরোধে সক্ষম এবং তা কার্যকর ভ্যাকসিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ। এরকম একটি তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এখন পর্যন্ত ৩২টি করোনা ভ্যাকসিন মানুষে বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে এবং সবগুলোই সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিনের মতো বিভিন্ন প্রাণীতে করোনা প্রতিরোধে সক্ষম বলেই মানুষে বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রায়ালে এসেছে। তাই বলে এটি কোনওভাবেই বলা যাবে না যে সবগুলো ভ্যাকসিন কার্যকর হবে। প্রাণীদেহের উপর এইসব ভ্যাকসিন গবেষণাগুলোতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, সিনোভ্যাক এর সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ভ্যাকসিনটি বানরের উপর ৩টি ডোজ প্রয়োগ করে শেষ ডোজ দেবার মাত্র ১ সপ্তাহ পর বানরের শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দেখা যায় প্রতিটি বানর কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ভাইরাস আক্রান্ত হওয়া থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। এতো অল্প সময়ে করা এই স্টাডি থেকে কোনোভাবেই অনুমান করা যায় না যে ভ্যাকসিনটি মানুষে করোনা প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা দিবে। মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন প্রাণীর উপর করা সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিনের গবেষণায় অ্যান্টিবডি কমে যাওয়ার লক্ষণ না দেখা গেলেও তাদের ফেজ-২ ট্রায়ালের ডাটা অনুযায়ী মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডির পরিমাণ সময়ের সাথে কমতে থাকে। সুতরাং, অন্য প্রাণীদের দিয়ে করা গবেষণা দিয়ে মানুষে একটি ভ্যাকসিন ফলপ্রসূ হবার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
প্রথম আলোর প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীনে শত শত প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে এই টিকা দিয়ে ভাইরাস নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যদিও বিবৃতিটি সত্য কিন্তু এর মাঝেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ফেজ-২ ট্রায়ালে সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিন দেবার পর রক্তে যে পরিমাণ অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় তা করোনা থেকে আরোগ্য হওয়া মানুষের রক্তে (কনভ্যালেসেন্ট সেরা) পাওয়া অ্যান্টিবডি থেকে ৩ থেকে ৫ ভাগ কম। অন্যদিকে ফাইজারের ভ্যাকসিন করোনা থেকে আরোগ্য হওয়া মানুষের রক্তের চেয়েও ৩-৪ গুণ বেশি পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা মডার্নার ভ্যাকসিন তৈরি করে ৫ থেকে ৮ গুণ বেশি, এবং অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন সমপরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সুতরাং, এই ক্ষেত্রেও সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের অগ্রাধিকার পায় না। তাছাড়া ১৮-৫৯ বছর বয়সের মানুষকে ৪টি বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে ভ্যাকসিন দেয়ার পর দেখা যায় বয়স যত বেশি ভাইরাস নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডির পরিমাণ ততই কমতে থাকে। এমতাবস্থায়, ৫৯ বছর বয়সী মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিন পর্যাপ্ত ভাইরাস নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডি তৈরি না করলে ৫৯ বছরের বেশি বয়সী মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিন কাজ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অথচ বয়স্ক মানুষরাই করোনায় বেশি ঝুঁকিতে আছে এবং তাদের জন্য একটি ভ্যাকসিন অবশ্যই প্রয়োজন। আইসিডিডিআর’বি এর বিজ্ঞানীরা এটি বেমালুম ভুলে গেলেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো করোনা ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ রোগের ইমিউন এনহ্যান্সমেন্ট করতে পারে, যা ভ্যাকসিন দেয়া মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। আইসিডিডিআর’বি এর বিবৃতি অনুযায়ী এটি সিনোভ্যাকসহ যেকোনো ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু একটি এটিতে দ্বিমত করার কিছু নেই। তবে একটি ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিনে নন-স্পেসিফিক অ্যান্টিবডি বেশি তৈরি হয় বলে সেইসব ভ্যাকসিনে ইমিউন এনহ্যান্সমেন্ট হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনকে সমর্থন করতে যেয়ে ব্রাজিলে মাত্র শুরু হওয়া সিনোভ্যাকের ফেজ-৩ ভ্যাকসিন ট্রায়ালে কোনও ইমিউন এনহ্যান্সমেন্ট দেখা যায়নি বলে যে মন্তব্য করা হলো তা সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। প্রকৃত পক্ষে ব্রাজিলে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই ট্রায়াল শুরু হয়েছে এবং এর কোনও ডাটা কোথাও শেয়ার করা হয়নি। উপরন্তু, একটি ভ্যাকসিন নিয়ে এতো অল্প সময়ের মধ্যে ইমিউন এনহ্যান্সমেন্ট বিষয়ে ধারণা করাও বাস্তব সম্মত নয়।
এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ব্রাজিলের রেগুলেটরি অথরিটি দ্বারা ফেজ-১ এবং ফেজ-২ এর ফলাফল পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে আইসিডিডিআর’বি এর বিবৃতিতে কি বোঝানো হলো তা বোধগম্য নয়। ইতিপূর্বে আফ্রিকায় ‘এইচআইভি ভ্যাকসিন’ এবং ফিলিপাইনে ‘ডেঙ্গু ভ্যাকসিন’ যে টিকা নেয়া মানুষদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে গেল, এমনকি মানুষ মারাও গেল সেই ভ্যাকসিনগুলোর ট্রায়াল চালানোর অনুমোদন কিন্তু সেসব দেশের রেগুলেটরি কমিটির অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছিল।
নতুন প্রজন্মের এমআরএনএ ভ্যাকসিন ও অ্যাডিনোভাইরাস বাহক ভ্যাকসিন বহুবিদ কারণে ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিন থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য। অথচ আইসিডিডিআর’বি এর বিবৃতিতে বলা হলো এগুলোর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
প্রকৃতপক্ষে, ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিন ব্যবহার নিরাপদ হলেও এটির দ্বারা পর্যাপ্ত ইমিউন রেসপন্স তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনও সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে পারেনি। সিনোভ্যাকের প্রকাশিত ডাটা অনুযায়ী টি-কোষের কোনও কার্যকর বৃদ্ধি বা সাইটোকাইন বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়নি যা অন্য সবগুলো ফেজ-৩ পৌঁছে যাওয়া করোনা ভ্যাকসিনে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। অন্যদিকে লাইভ ভ্যাকসিন দিয়ে পর্যাপ্ত ইমিউন রেসপন্স তৈরি করা গেলেও এটিতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। অ্যাডিনোভাইরাস বাহক ভ্যাকসিনগুলো ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিনের মতো নিরাপদ এবং লাইভ ভ্যাকসিনের মতো পর্যাপ্ত ইমিউন রেসপন্স তৈরি করতে পারে।
অ্যাডিনোভাইরাস আমাদের দেহের সবচেয়ে কার্যকরী অ্যান্টিজেন প্রেজেন্টিং কোষকে (ডেনড্রাইটিক কোষ) সক্রিয় করে যা টি-কোষের সাহায্যে বি-কোষের মাধ্যমে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন জার্নালে প্রচুর আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞানে আগ্রহী যে কেউ শুধুমাত্র ২টি রিভিউ পড়লেই অ্যাডিনোভাইরাস বাহক ভ্যাকসিনের উপকারিতা সম্পর্কে একটি ধারণা পাবে। এই দুটি রিভিউয়ের একটি লিখেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. টিম ডুডেক ও ডেভিড নাইপ (ভাইরোলজি,২০০৫) এবং আরেকটি লিখেছেন এনআইএইচ এর ড. মার্জোরি রবার্ট (ক্লিনিক্যাল ওপিনিয়ন বায়োটেকনোলজি,২০০৭)।
মজার বিষয় হচ্ছে, স্বয়ং চীন সরকার ক্যানসিনো বায়টেক কোম্পানির অ্যাডিনোভাইরাস বাহক ভ্যাকসিন এড৫-কোভিড-১৯ কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সিনোভ্যাক এর ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিনকে নয়। কারণ চীন সরকার গত জুন মাসে চীনের মিলিটারিতে এড৫-কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
আইসিডিডিআর’বি এর বিবৃতি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কোনও এমআরএনএ ভ্যাকসিন মানুষে ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স পায়নি। বিবৃতিটি সত্যি কিন্তু তার কারণ হচ্ছে যেহেতু এটি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি আর ভ্যাকসিন তৈরি লম্বা প্রক্রিয়া তাই লাইসেন্স পর্যন্ত যেতে আরও সময় প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র মডার্না কোম্পানির কমপক্ষে ১০ টি এমআরএনএ ভ্যাকসিন/চিকিৎসা ব্যবস্থা মানুষে বিভিন্ন ফেজে ট্রায়াল চলছে যার মধ্যে ক্যান্সার সহ জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া, আরএসভি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস অন্যতম।
পরিষ্কারভাবেই যতগুলো করোনা ভ্যাকসিন ফেজ-৩ তে পৌঁছেছে সেগুলো বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন করোনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে। চীনের এমন মানহীন ভ্যাকসিন তৈরি নতুন কিছু নয়। মাত্র ২ বছর আগে ২০১৮ সালে চীনের চ্যাংসেঙ বায়টেক কোম্পানি ২১৫,১৮৪ চাইনিজ শিশুকে মানহীন ডিপিটি (ডিপথেরিয়া, পারটুসিস, টিটেনাস) টিকা প্রয়োগ করে। একই সময়ে আরেকটি চাইনিজ কোম্পানি উহান ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস ৪ লাখের উপর মানহীন ডিপিটি ভ্যাকসিন বিক্রয় করে। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন সরকার চ্যাংসেঙ কোম্পানির চেয়ারম্যান সহ ১৫ জনকে আটক করে। ব্যাপারটি জানাজানি হবার পর বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তুমুল হৈচৈ পরে যায়। ওই ঘটনা বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার, ল্যানসেট সহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম যেমন নিউ ইয়র্ক টাইমস ও সিএনএন ফলাও করে প্রকাশ করে।
এতসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি জুলাই মাসের ৩১ তারিখ বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে ডেভিড সাইরানস্কি বিভিন্ন দেশে চাইনিজ ভ্যাকসিনের ফেজ-৩ এর অনুমোদন পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ জনক একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। অথচ আইসিডিডিআর’বি কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ছাড়াই সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন নিয়ে অত্যুত্সাহী হয়ে উঠেছে।
ফেজ-৩ ট্রায়ালে বিভিন্ন দেশের ২০-৫০ হাজার সুস্থ মানুষকে ভ্যাকসিন প্রদান করে তার ফলাফল পর্যালোচনা করে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারলেই ভ্যাকসিন বাজারে আসার প্রশ্ন। বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োজন তেমনি ফেজ-৩ তে পৌঁছে যাওয়া কোম্পানিগুলোরও বাংলাদেশের মতো করোনা আক্রান্ত দেশে ট্রায়াল করা প্রয়োজন। তাই শুধুমাত্র পর্যাপ্ততার কারণে প্রকৃত তথ্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ না করে তাড়াহুড়া করে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। দেশের জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। শুধুমাত্র চুক্তি ভিত্তিক রিসার্চ অর্গানাইজেশনের উপর ভিত্তি করে যেকোনো ভ্যাকসিন ট্রায়াল অনুমোদন করা উচিত নয়। নিরপেক্ষ ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞদের কার্যকরী টিমের তত্ত্বাবধানে দেশে যেকোনো ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন এবং তা মনিটরিং এর ব্যবস্থা করলে দেশে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বা মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
লেখক: ড. মোহাম্মদ শামছুল আলম, ইমুনোলোজিস্ট এবং স্টাফ সায়েন্টিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ, মেরিল্যান্ড, ইউএসএ।
ড. জুবায়ের রহমান, ইমুনোলোজিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ, মেরিল্যান্ড, ইউএসএ।
ড. রেজাউল করিম, ইমুনোলোজিস্ট এবং প্রজেক্ট লিড, ডব্লিউএইচও-ইউট্রেক সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ফর এফোরডেবল বায়োথেরাপিউটিক্স, নেদারল্যান্ডস।
Leave a reply