এখন থেকে কুড়িগ্রাম চলবে মঞ্জু মিয়ার কথায়, এ কথা বলেই কবজি কাটা হয় শিক্ষকের

|

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,রংপুর:
কুড়িগ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কলেজ শিক্ষক আতাউর রহমান মিন্টুর অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তার ডান হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন ছাড়াও বাম হাতের কবজি ঝুলে আছে। কেটে দেয়া হয়েছে দুই হাঁটুর নীচের রগও। এ ঘটনাকে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পন্থী বাঁধন বাহিনীর কাজ বলে অভিযোগ করেছেন মিন্টু ও তার স্বজনরা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই হামলাকারীদের শাস্তি দাবি করেছেন তারা।

মঙ্গলবার, দুপুর আড়াইটায় রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামে মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হন কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি ও কুড়িগ্রাম মজিদা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আতাউর রহমান মিন্টু। সন্ত্রাসীরা তার ডান হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বাম হাতের কবজিও বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। দুই পায়ের হাঁটুর নীচের রগও কেটে দেয় তারা। মুমুর্ষ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তৃতীয় তলার ৩১ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে চিকিৎসকরা ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।

রাত সাড়ে ৭ টায় এম্বুলেন্সে যোগে (ঢাকা মেট্রো-ছ-৭১-১৫৮৪) তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। এম্বুলেন্সের ড্রাইভার ছলিম উদ্দিন জানান, আমি ঢাকা বক্ষ-ব্যাধি হাসপাতাল থেকে সোমবার রাতে রংপুর এসেছিলাম। এখন এই রোগীকে নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যেখানে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন পড়বে সেখানে থামতে হবে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অর্থ-সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. প্রফেসর সফিকুল ইসলাম, তার ডান হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর বাম হাতের কবজিওটি ঝুলে ছিল। ওই হাতে অবস্থা সংকটাপন্ন। দুই হাঁটুর নীচের রগ কেটে দেয়া হয়েছে। সেগুলো অপারেশন করতে হবে। আমরা প্রাথমিকভাবে তার রক্ত দেয়া সহ অন্যান্য সব বিষয়ে ট্রিটমেন্ট করেছি। আমরা মনে করেছি তাকে আরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। সেকারণেই তাকে ঢাকা পুঙ্গ হাসপাতালে রেফার্ড করেছি। পরিবারের সদস্যরা একটি এম্বুলেন্স যোগে সড়কপথে তাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছেন।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন হামলার শিকার কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ সদস্য সাবেক এমপি জাফর-আলীর ভাগনা আতাউর রহমান মিন্টু সন্ধ্যা ৭ টায় জানান, রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের পালপাড়ায় আমার বৃক্ষের প্রকল্পের দিকে যাচ্ছিলাম। তারা আমার পথরোধ করে হামলা চালায়। হামলাকারীরা কুড়িগ্রাম জেলার হাতকাটা বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এই বাহিনীর প্রধান হলেন বাঁধন। তার গ্রুপের সবাই আমার ওপর হামলায় চালায়। গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু আসার পর এই হাতকাটা বাঁধন বাহিনী আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। আমি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জাফর আলীর গ্রুপ করার কারণেই তারা আমার ওপর হামলাটি চালায়।

তিনি বলেন, ওরা যখন আমার ওপর হামলা চালায় তখন বলেছিল তোর এত-বড় কলিজা, তুই জাফর মিয়ার রাজনীতি করিস, এখন কুড়িগ্রাম মঞ্জু মিয়ার কথার ওপর চলবে, একথা বলতেছে আর তারা আমাকে চটাইতেছে। হামলাকারীরা যুবলীগের সমর্থক। ওদের দলীয় কোন পোস্ট নেই। ওরা হাতকাটা গ্রুপ নামে পরিচিত। এর আগেও ওরা একজনের হাত কেটে দিয়েছিল।

মাস তিনেক আগেও আমার বাসায় গুলি করছে ওরা। সেই গুলির দাগ এখনও গেটে লেগে আছে। আমি ওসি সাহেব, এসপি সাহেবকে বলেও কোন লাভ হয়নি। মিন্টুর অভিযোগ ওই সময় পুলিশ সরেজমিন তদন্ত না করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট চায়।

মিন্টু বলেন, আমি চাই এর সঠিক বিচার। ওদের হাত থেকে সাধারণ মানুষ যেন হেফাজত হয়। আমার এই তথ্যটা আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই। আমি কোন অন্যায় করিনি, বিনা অপরাধে তারা আমাকে পঙ্গু করে দিলো। আজকে আমি পঙ্গু, আমার কোন দোষ নাই। এটা আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ এর বিচার করতে পারবেন না।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কেউ এটার কোন সমাধান হবে না। কারণ জেলায় উপজেলায় প্রশাসন দুর্নীতিতে ভরা। যার শক্তি বেশী। যে যখন টাকা দিবে তার পক্ষেই কথা বলে প্রশাসন। সেকারণে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করে, তাদের জায়গা নেই। তারা পঙ্গু হয়।

এ ঘটনায় নির্বাক মিন্টুর ৫ মাসের অন্ত:স্বত্বা স্ত্রী নওরিন। ন্ত্রী ও ৫ বছরের কন্যা মুনের আহাজারিতে সবার চোখেই জল। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি পরিবারের সদস্যদের।

নির্বাক হয়ে যাওয়া স্ত্রী এম্বুলেন্সের সামনে পঙ্গু স্বামীকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিলেন। অস্ফুট স্বরে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমার স্বামীকে আপনি ভালো করে দেন। সন্ত্রাসীদের ফাঁসি দেন।

চোখের সামনে টববগে তরুণ পুত্রের পঙ্গুত্ব থেকে মিন্টুর পিতা আলতাফে হোসেন সরকার বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। বললেন, কুড়িগ্রামে আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপ একটা জাফর আরেকটা মঞ্জু। আমার ছেলে জাফর গ্রুপ। মঞ্জু গ্রুপের ছেলেরা আমার ছেলেটাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে পঙ্গু করলো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার চাওয়া সুষ্ঠু ও সূক্ষ্ম বিচার চাই আমি। এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক আর কেউ যেন এ ধরণের কাজ করার সাহস না পায়। এসময় তার বুকে পড়ে কান্না করছিলেন তার পুত্রবধূ নওরিন।

মিন্টুর মা মনোয়ারা বেগম ছকিনা জানান, এটা মঞ্জু গ্রুপ করেছে। মঞ্জু গ্রুপের ছেলে বাঁধনরা আমার সোনার ছেলেটাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এর আগেও তারা হাত কেটেছে। তার বিচার হয় নি। দুই মাস আগে আমার ছেলের বাড়ি ভাংচুর করছে, পুলিশকে মামলা দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয় নি। এলাকায় অনেককে এরা এভাবে হাত কেটে দিচ্ছে। মারধোর করছে। কিন্তু পুলিশ কোন মামলা নেয় না।

মিন্টুর শশুড় নুরুল ইসলাম চাঁদ জানান, আওয়ামীলীগে জাফর গ্রুপ করতো আমার জামাই। মঞ্জু গ্রুপের হাতকাটা বাহিনীর প্রধান বাঁধনের নেতৃত্বে তারা আমার জামাইকে মোটরসাইকেলে হামলা করে হাত কেটে দিয়েছে। তিনি বলেন এর আগের ঘটনায় জিডি করাও আছে। কিন্তু পুলিশ কোন সুরাহা করেনি। আমি শশুড় হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই এটার সঠিক বিচার হতেই হবে।

ঘটনাস্থল রাজারহাট থানার ছিনাই ইউনিয়নের বিট পুলিশ অফিসার তছির উদ্দিন জানান, এর আগের ঘটনাগুলো সদরের কাঠালবাড়ি এলাকায়। সেকারণে ওসব বিষয়ে কিছুই বলতে পারছি না।

তবে তাকে কাঠালবাড়ি থেকেই টার্গেট করা হয়েছিল। এটা আমার এলাকায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য আমরা সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছি।

এ ঘটনার পর কুড়িগ্রামে দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে। কাঁঠাল বাড়ি এবং শাপল মোড় এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছেন জাফর-পন্থীরা।

কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা জানান, হামলার শিকার আহত মিন্টুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি হামলাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply