ইয়াজিম পলাশ:
ধর্মীয়, রাজনৈতিক আবেদনের উর্ধ্বে অনন্য এক স্থাপত্য নিদর্শন হয়ে রয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের ‘হাজিয়া সোফিয়া’। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরটি যেমন দুটি মহাদেশের সহাবস্থানের প্রতীক, তেমনি ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের সহাবস্থানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘হাজিয়া সোফিয়া’। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছিল প্রায় ১,৫০০ বছর আগে। একটি বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান ব্যাসিলিকা হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে অনেকটা প্যারিসের আইফেল টাওয়ার বা এথেন্সের পার্থেননের মতো এটিও একটি অসাম্প্রদায়িক স্থাপত্যশৈলী হিসেবে পরিগণিত হয়। অবশ্য শুধু স্থাপত্য কৌশলের কারণেই যে এটি বিখ্যাত তা নয়, এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটির রয়েছে নানা রকম রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং শৈল্পিক আবেদন।
তুরস্কের পুরাতন অংশে বসফরাস প্রণালীর কোল ঘেঁষে নির্মিত এই স্থাপনাটি সনাতন খ্রিস্টান এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষের কাছেই মর্যাদার বস্তু। কেননা, তুরস্কের বহুবছরের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের ধারক-বাহক এই স্থাপনা। ইতিহাসের পালাবদলের সাথে সাথে বিভিন্ন সময় বদল হয়েছে এর পরিচয় এবং ব্যবহার। এটি বানানো হয়েছিল বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের উপাসনালয় হিসেবে। কালের বিবর্তনে এটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক সনাতন খ্রিস্টানদের ক্যাথেড্রাল, রোমান ক্যাথলিকদের ক্যাথেড্রাল এবংমুসলিমদের মসজিদ হিসেবে। কিছুদিন আগেও এটি সব ধর্মের মানুষদের জন্য জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত ছিল। তবে প্রায় ৮৫ বছর পর বর্তমানে এটি মসজিদ হিসেবে আবার ব্যবহৃত হচ্ছে। (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২০২০)
হাজিয়া সোফিয়ার তুর্কি নাম ‘আয়া সোফিয়া’। একে ‘পবিত্র জ্ঞানের চার্চ’বা ‘স্বর্গীয় জ্ঞানের চার্চ’নামেও ডাকা হয়। সর্বপ্রথম ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সটান্টিয়াস, বাইজেন্টাইন ব্যাসিলিকা হিসেবে হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণের নির্দেশ দেন। সে সময় ইস্তাম্বুল শহরটির নাম ছিল কন্সটান্টিনোপল। সম্রাট কন্সটান্টিয়াসের বাবা, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট, প্রথম কন্সট্যান্টাইনের নামানুসারেই শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল। প্রথম নির্মিত হাজিয়া সোফিয়ার ছাদ ছিল কাঠের তৈরি। রাজপরিবারের রাজনৈতিক কলহের জেরে ৪০৪ খ্র্রিস্টাব্দে সে ছাদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। এরপর ৪১৫ সালে হাজিয়া সোফিয়া নতুন করে নির্মাণ করেন সম্রাট থিওডোসিওস। এক শতাব্দির কিছু বেশি সময় টিকে ছিল দ্বিতীয়বারে নির্মিত হাজিয়া সোফিয়া। দ্বিতীয়টিরও কপালে জুটেছিল আগুনের আঁচ। সে বারে হাজিয়া সোফিয়া পুড়েছিল সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে প্রজাদের বিদ্রোহের আগুনে।
দ্বিতীয়বার পুড়ে ছাই হওয়া হাজিয়া সোফিয়াও মেরামতের অযোগ্য ছিল। তাই সম্রাট জাস্টিনিয়ান ৫৩২ সালে নতুনভাবে এ গির্জা নির্মাণের আদেশ দেন সে সময়ের দুই বিখ্যাত স্থপতি ইসিডোরোস এবং অ্যান্থিমিয়োসকে। এই তৃতীয়বার নির্মিত অনন্য সাধারণ হাজিয়া সোফিয়ার নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে, যা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বগৌরবে। (লাইফসাইন্স, ২০২০)
৯০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে হাজিয়া সোফিয়া। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সংগঠিত ক্রুসেডে হাজিয়া সোফিয়া কিছু সময়ের জন্য রোমানদের দখলে চলে যায়। সে সময় এটি রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিছুকাল। যত দিনে বাইজেন্টাইনরা পুনরায় এই স্থাপত্যের দখল ফিরে পায়, ততদিনে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাই বাইজেন্টাইন শাসকগণ আবারও মেরামত করে তাদের সাধের প্রার্থনালয়ের পুরনো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনেন।
পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অটোম্যান সম্রাট ফাতিহ্ সুলতান মেহমেদ কন্সট্যান্টিনোপল দখল করেন। অটোমানরা কন্সট্যান্টিনোপলের নতুন নাম দেয় ইস্তাম্বুল। সে সময় আবারও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বাইজেন্টাইনদের প্রধান প্রার্থনালয় হাজিয়া সোফিয়া। ইস্তাম্বুলের উপর অটোমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে রূপান্তরের চিন্তা করে। হাজিয়া সোফিয়ার ভেতরের অনেক খ্রিস্টীয় নিদর্শনকে তারা বদলে ফেলে। সময়ের পরিক্রমায় এমন অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে হাজিয়া সোফিয়া ব্যবহৃত হতে থাকে মুসলিমদের প্রার্থনালয় মসজিদ হিসেবে। (তুর্কি ফর ইউ, ২০১৯)
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের একশ বছরেরও বেশি সময় পরে আজও রাজনীতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে হাজিয়া সোফিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নয় বছর পরে, ১৯৩৫ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। তখন বাইজেন্টাইন আমলের বিভিন্ন খ্রিস্টীয় প্রতীক ও ছবি পুনঃস্থাপন করা হয় হাজিয়া সোফিয়াতে। খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের ধর্মের নানা প্রতীক এবং বাণী পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যেতো হাজিয়া সোফিয়াতে। একপাশে মোহাম্মদ, অন্যদিকে আল্লাহ লেখা আবার মাদার মেরির কোলে যিশুখ্রিস্ট সবই ছিল এখানে। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধর্ম বিশ্বাসের আশ্চর্য এক সহাবস্থান চোখে পড়ে জাদুঘরটিতে। বিভিন্ন সময়ে হাজিয়া সোফিয়া খ্রিস্টান এবংমুসলিমদের প্রার্থনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে এ স্থাপনাটিতে খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের ধর্মের নানা অনুসঙ্গের সহাবস্থান চোখে পড়ে। এ দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষদের ধ্যান-ধ্যারণা আর চিন্তা-ভাবনা এসে যেন এক হয়ে মিলে গেছে হাজিয়া সোফিয়াতে।
তবে হাজিয়া সোফিয়া যে অনন্তকাল পর্যন্ত এভাবেই ভিন্ন দুটি ধর্মের সহাবস্থানের প্রতীক হয়ে টিকে থাকবে সেটা বলা মুশকিল। ২০২০ সালে ৮৫ বছর পর এটি আবার মসজিদে পরিণত হয়। তবে প্রায় একশত বছর পর্যন্ত যে এ স্থাপনাটি ভিন্ন দুটি ধর্মবিশ্বাসের আশ্চর্য এক মেলবন্ধন হিসেবে ছিল, সেটিও নেহায়েত কম নয়। ইতিহাসের প্রয়োজনেই আবার হয়তো দুটি ধর্মের সহাবস্থানের অনন্য স্থাপনা হয়ে উঠতে পারে ‘হাজিয়া সোফিয়া’।
লেখক: নিউজরুম এডিটর, যমুনা টেলিভিশন।
Leave a reply