স্টাফ রিপোর্টার:
মাদারীপুরে কথিত পরকীয়ার অভিযোগ তুলে প্রহসনমূলক শালিস বসিয়ে ধর্ম ভাই-বোনকে ১‘শ জুতাপেটা করেছে প্রভাবশালী একটি মহল। পরে তাদের জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ঘুরিয়ে সমাজচ্যুত করে ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের সুতারকান্দি গ্রামে। মাদবরদের ভয়ে বিষয়টি প্রথমে গোপন রাখা হলেও মঙ্গলবার লোকমুখে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনাটি মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে বলে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে প্রশাসন, পুলিশ, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষ।
ঘটনায় মামলা হলে রাজৈর থানা পুলিশ ৩ শালিসিকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর গ্রামের মনির মিয়ার (৪০) সাথে রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের সুতারকান্দি গ্রামের ছাবেদালী ফকিরের স্ত্রী খোদেজা বেগমের (৫০) ধর্মীয়ভাবে আত্মীয়তা রয়েছে। তারা ধর্ম ভাই-বোন হিসেবে উভয়ের বাড়ি যাতায়াত ছিল। আত্মীয়তা সূত্রে ধরে গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ৯টার দিকে মনির মিয়া তার বোন খোদেজা বেগমের বাড়ি বেড়াতে আসেন। কিছুক্ষণ পরেই একই বাড়ির কালু ফকির, ইমরান ফকির, শাকিব আকন, রানা ফকির, শামীম ফকিরসহ ৮/১০ জন খোদেজা ও মনিরকে ঘর থেকে টেনে হিচড়ে বের করে বাইরে আনে। পরে খোদেজা ও মনিরকে বেঁধে ফেলে।
এক পর্যায় বাড়ির উঠানে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রহসনের শালিস বসায়। শালিসিতে কালু ফকির গং কারো বক্তব্য না শুনে তাদের ইচ্ছেমত রায় ঘোষণা করে। রায় অনুযায়ী থোদেজা ও মনিরকে ১০০ জুতাপেটা, জুতার মালা পরিয়ে সারা এলাকা ঘুরানো ও তাদের ঘরে তালা ঝুলিয়ে এলাকা থেকে বের করার রায় ও সমাজচ্যুত করা হয়। সাথে সাথে ইমরান ফকির, কালু ফকির আজিজুলসহ ৮/১০ জন শত শত মানুষের সামনে ওই দু’জনকে মধ্যযুগীয় কায়দায় ১০০ জুতা পেটা করে জুতার মালা পরিয়ে সারা এলাকা ঘোরায়। পরে খোদেজা বেগমের ঘরে তালা ঝুলিয়ে এলাকা থেকে বের করে দেয়া হয়। অমানবিক ও ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় উৎসুক জনতা শুধু দেখেছে।
কিন্তু প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। শনিবার রাতে শালিসের প্রধান হোতা কালু ফকির, ইমরান ফকির, শামীম ফকিরসহ ৭ জনের নামলেখ ও অজ্ঞাত ৮/১০ জনের নামে রাজৈর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে ভুক্তভোগীর স্বামী। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রধান সালিশ কালু ফকির, আজিজুল ফকির ও শাকিব আকনকে গ্রেফতার করে মাদারীপুর জেল হাজতে প্রেরণ করেছে।
নির্যাতনের শিকার খোদেজা বেগম বলেন, ‘ওরা আমাকে ও আমার ভাইকে জোর করে বাইন্দা গ্রামের সবার সামনে ১০০ জুতার বাড়ি দিছে, জুতার মালা পরাই সারা গ্রাম ঘুরাইছে। আবার মোর ঘরে তালা দিছে। এহন আমরা ওগো ভয়তে গ্রাম ছাড়া।
এলাকার মেম্বার তারা মিয়া বেপারী বলেন, ‘ধর্মের ভাই-বোনকে কথিত বিচারের নামে একটি প্রহসনের শালিস বসায়। শালিসে এলাকার মেম্বার হিসেবে আমার কোন কথাই তারা শোনেনি। এমনকি নির্যাতিত ওই নারীর কোন কথা না শুনে কালু ফকির, ইমরান ফকির, শামীম ফকির, রানা ফকির গং নিজেদের ইচ্ছেমত রায় ঘোষণা করে। কথিত বিচারে ওই নারী ও তার ধর্ম ভাই মনিরকে ১০০ জুতা পেটা ও জুতার মালা পরিয়ে সারা এলাকায় ঘুরানোর রায় দেয়া হয়। সাথে সাথে কালু , ইমরান, রানা গংরা তাদের বেঁধে উভয়কে ১০০ করে জুতা পেটা করে। এ সময় ওই নারীর আত্মচিৎকার ও আর্তনাদে এলাকার আবাল বৃদ্ধ বণিতার চোখে পানি আসলেও কথিত সমাজপতি মাতুব্বরদের মন গলেনি। তারা উপর্যুপরি ওই নারী ও তার ধর্ম ভাইকে ১০০ জুতা পেটা করে। এক পর্যায় সমাজপতিরা তাদের জুতার মালা বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে সারা এলাকায় ঘুরায়।’
বাজিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘জঘন্যতম কাজটি যারা করেছে, যারা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে তাদের এবং এর পেছনে ইন্ধনদাতাদেরও বিচার হওয়া উচিৎ।’
খোদেজা বেগম স্বামী ছাবেদালী ফকির বলেন, ‘আমি আইজ দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে আমার স্ত্রী খোদেজা বেগমকে নিয়ে ঘর-সংসার করে আসছি। তার চরিত্র খারাপ হলে আমিই আগে জানতাম। যদি আমার স্ত্রী কোন অপরাধ করে থাকে তাহলে বিচার করতাম। ওনারা কেন আমার স্ত্রী ও আমার আত্মীয়কে জুতাপেটা করে জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ঘুরালো? এখন তারা বিচারের নামে আমাগো ঘরে তালা দিয়ে বের করে দিল। আমি ও আমার স্ত্রী ঘরে যেতে পারছি না। আমাগো সমাজচ্যুত করার হুমকি দিচ্ছে, ভয়ে আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমার ছেলে মেয়ে আছে, তাদের বিয়ে দিয়েছি, নাতি-নাতনি রয়েছে। আমরা কীভাবে মানুষরে মুখ দেখাবো। আমি এর বিচার চাই।’
প্রহসনের শালিসের প্রধান হোতা কালু ফকির বলেন, ‘ওই মহিলা খুবই বাজে চরিত্রের লোক। তাই একটু শাসনের জন্য শালিস করা হয়। শালিসে অনেক মাতুবাবর ছিল। তারা সবাই মিলে এ রায় দেয়।
রাজৈর থানার ওসি শেখ সাদী বলেন, ‘ঘটনা শোনার সাথে সাথে আমরা থানায় মামলা নিয়েছি। রাতে অভিযান চালিয়ে এ ঘটনার মুল হোতা কালু ফকিরসহ ৩ জনকে গ্রেফতার
করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্বরোচিত এ ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। বাকি আসামীদের ধরার ব্যাপারে জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’
মাদারীপুর জেলা বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পিপি এড, সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, ‘কাউকে বিচারের নামে জুতাপেটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। কেউ এ ধরণের বিচার করলে তারও বিচার হবে। মধ্যযুগীয় ও বর্বরোচিত এ ধরণের অপরাধের জন্য আইনে কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।’
রাজৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। আমার কাছে ওই নারী এসেছিল এবং একটি অভিযোগ দিয়েছিল। আমি সাথে সাথে থানাকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি।’
Leave a reply