তুরস্কের কৃষ্ণসাগর পাড়ের গ্রাম কুস্কয়। পর্বত, সবুজ উপত্যকা আর সাগরের সঙ্গমে বাস করা এখানকার পরিশ্রমী মানুষগুলোর যোগাযোগের অন্যরকম এক ভাষা আছে। বিজ্ঞানীরা ভাষা গবেষণার এক নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন স্থানীয়দের মাঝে। সাধারণ মানুষ তো বটেই ভাষার এই অন্য দিগন্তের সামনে হতবাক খোদ গবেষকরাই।
বিজ্ঞানী ওনোর গুনটারকুন কুস্কয়ে যান ভাষার পরীক্ষা চালাতে। তিনি লক্ষ্য করেন কুস্কয়ের অধিবাসীরা একধরণের শীস দেয়ার মত শব্দ করে আরেকজনকে কিছু বলছেন। পর্বত উপতক্যায় এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব অনেক। কাছে গিয়ে জরুরী কথা বলে আসার সময় পেতেন না সেখানকার অধিবাসীরা। তখন তো আর মোবাইল ফোনও ছিল না। তাই কেউ উঠান থেকে শীস দিয়ে প্রতিবেশীকে কিছু বলতেন। তাতে প্রতিবেশীও বুঝতো হয়তো কাল ধান কাটতে সাহায্য করার অনুরোধ এসেছে।
মাঝে মাঝে তীব্র করুণ স্বর একটানা বেজে ফিরতো কুস্কয়ের পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে। কাজ ছেড়ে মানুষ উঠে দাঁড়াত। এটি মৃত্যুসংবাদ। পুরো গ্রাম তখন তৈরী হত শেষকৃত্যে।
কুস্কয়বাসী তাদের নিজেদের এই ভাষাকে ডাকে ‘পাখির ভাষা’ নামে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাখির ভাষা কচি মুখে উঠে এসেছে সংস্কৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। তবে প্রযুক্তির কল্যাণে (কিংবা বলা যায় থাবায়) এ ভাষা খুব বেশি ব্যবহৃত হয় না এখন। এরকম উচ্চগ্রামের ভাষা কিন্তু স্পেনের ক্যানারি দ্বীপেও প্রচলিত। আমাজন এবং আফ্রিকার নিবিড় বনাঞ্চলেও আবেগ প্রকাশের এমন রীতি দেখা যায়। কিন্তু সেগুলো কমবেশী সাংকেতিক ভাষা। এইসব বচনে কিছু ভাব বড়জোর দুএকটি অনুভব প্রকাশ করা যায়, যেমন কেমন আছ? কাজ কি শেষ? ইত্যাদি।
কুস্কয়ের ভাষাটা একেবারে মৌখিক ভাষার মতই। নিখুঁত বাচনিক এর কার্যকারিতা। ওনোর গুনটারকুন এক প্রবীণকে পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটি ফোন নম্বর বলেন। তারপর পাখির ভাষায় সেই নাম্বার বলে তাতে ফোন করতে বলা হয় আরেক গ্রামবাসীকে। কিছুক্ষণ পরেই রিঙটোন গুনগুন করে জানিয়ে দেয় প্রাচীন যোগাযোগের রীতি নাম্বার ভুল করেনি।
এই পর্যবেক্ষনের পরই বাচনিক ভঙ্গিটির বৈজ্ঞানিক গুরুত্ত্ব বুঝতে পারেন ওনোর গুনটার। এটি কোন সাংকেতিক ভাষা নয় এবং ধ্বনি বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্র উন্মোচিত হবার পর ওনোর একটি পরীক্ষা করেন।
আমরা জানি মস্তিস্কের ডান এবং বাম বলয়ের কাজ পৃথক। ডান বলয় সঙ্গীত, স্বরের উঠানামা, সুর, তাল ইত্যাদিতে উদ্দীপ্ত হয়। এ কারণেই গানের কথা দূর্বোধ্য হলে মস্তিস্কে ‘কগনেটিভ’ চাপ পড়ে। গান ভাল লাগে না। কিন্তু কবিতায় এমন হয় না। রূপক বা হেয়ালিও তাতে বেশ লাগে। কারণ এক্ষেত্রে বাম বলয় যোগাযোগ বা বাচনিক ভাষার কাজটি করে।
কুস্কয়ের পাখির ভাষা একই সাথে বাচনিক এবং অবশ্যই সুরেলা। এক্ষেত্রে দুটি বলয় তো একইরকম কাজ করতে পারে না। কারণ বাম বলয়ে ভাষা প্রক্রিয়াকরণ করে মস্তিস্কে সংকেত পাঠানোর সাথে সাথে ডান বলয়ে সুরের উঠানামার অর্থ একইসাথে বোঝা সম্ভব নয়। অন্তত এখনকার বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী। কিন্তু কুস্কয়ে ঠিক এটিই হচ্ছে। শুধু তাই না, চমৎকার ভাবেই হচ্ছে।
ওনোর প্রথমে স্থানীয়দের হেডফোনে দুই কানে আলাদা দুটি তুরস্কের মৌখিক ভাষার রেকর্ড শোনান। দেখা যায় ডান কানের রেকর্ডটিতে সবাই মনোযোগ দিচ্ছে। কারণ ডানকান নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিস্কের বাম বলয়। সেখানেই ভাষা প্রক্রিয়াজাত হয়। কিন্তু দুই কানেই যখন শীসধ্বণির ভাষা বা পাখির ভাষার ভিন্ন দুটি রেকর্ড চালানো হয় তখন মস্তিস্কের দুই বলয় কম বেশী সক্রিয় হয়ে উঠছে। শোনার পর দুটি রেকর্ডই মোটামুটি বলতে পারছেন স্থানীয়রা।
গ্রামের বৃদ্ধা মহিলা নাযমিয়ে সাকির আলাপচারিতায় জানান দৈনন্দিন জীবনের সব কথায় এই ভাষায় বলা যায়। এসময় তার কিশোরী কণ্যা এক প্রশ্নের জবাবে বলে আবেগ, রাগ, বিরাগ সবই বলেন তারা এ ভাষায়। নিচু গলায় জানান ‘ভালোবাসার কথা’ ছাড়া। -‘এ ভাষায় বললে ধরা পড়ে যাবো যে।’- কিশোরীর রসিকতায় হেসে ওঠে সবাই।
তা হোক। ভালবাসা প্রকাশে কি কোন ভাষা লাগে? প্রত্যন্ত নিঝুম কুস্কয়ের পাখির ভাষার এই অক্ষমতা উপেক্ষা করা যায়। পাহাড়ি সেই উপত্যকায় প্রযুক্তির পাশাপাশি টিকে থাকুক কুস্কয় ভাষাভাষী।
Leave a reply