সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস ‘জলপাই রঙের কোট’ রবিউল করিম মৃদুল রচিত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ভিত্তিক বর্ণনাধর্মী আখ্যায়িকা। বহুল আলোচিত এই উপন্যাসে লেখক অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক ও হৃদয়স্পর্শীভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের পাশাপাশি তৎকালীন নানা অস্থিরতাকে তুলে এনেছেন। রচনা করেছেন এক অনবদ্য জীবনালেখ্য। যা ঘোরগ্রস্ত করে ফেলে। যা ব্যাপক ভাবে নাড়িয়ে দেয় আমাদের চেতনাকে। বিষণ্ন করে তোলে, হৃদয়ে বেজে উঠে কান্নার ধ্বনি কখনো কখনো। কখনো আবার পাঠক অন্যরকম তেজদীপ্ত দৃঢ়তায় খুঁজে পায় নিজেকে।
উপন্যাসে তিনটি আখ্যান প্রায় সমান্তরালে বর্ণিত হয়েছে। এর একটি- তিন তরুণের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প সংগ্রহের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে সাক্ষাৎ, দ্বিতীয়টি মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত নানা ঘটনাবলী, আর শেষটি স্বাধিকার আন্দোলনের দুই বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ইতিহাস। তিনটি আখ্যান তিনটি সময়কে নির্দেশ করে। লেখক আখ্যানগুলো বর্ণনায় গতানুগতিক ধারার মধ্য দিয়ে না গিয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছেন। তিনি কখনো বর্তমানে, কখনো ৭১-এ, আবার কখনো বা স্বাধিকার আন্দোলনে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। এই লেখনী রচনায় লেখক তার ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কাহিনী আঙ্গিকে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি।
উপন্যাসে তিন তরুণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প সংগ্রহের জন্য ঢাকা থেকে যায় চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার গৈরালা গ্রামে। যে গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের অজস্র ঘটনার স্বাক্ষী বহন করে। তরুণত্রয়কে তাদের আংকেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় সেসব যুদ্ধের স্মৃতি। এই গ্রামেই জন্ম হয় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুজিতের। সুষমার ঘরে জন্মগ্রহণ করা সুজিত একজন মেধাবী ও দুরন্ত বালক। যার রয়েছে নিজ কর্মক্ষেত্রে একরোখা মনোভাব আর তেজদীপ্ত সাহস। উপন্যাসের শুরুতেই এই বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। যে সুজিত প্রতিনিধিত্ব করে সে সময়ের লাখো তরুণের। যে তরুনেরা দেশ মাতাকে রক্ষা করার জন্য নিজের মায়ের ভালবাসা, পরিবারের ভালবাসাকে ত্যাগ করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। অংশগ্রহণ করেছে সম্মুখ যুদ্ধে। যা শুনলে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। সুজিতকে লেখক নির্মাণ করেছেন অনন্য দৃঢ়তার প্রতিক হিসেবে।
প্রতিটা ঘটনার একটা করে পরম্পরা থাকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা আন্দোলন একদিনে রচিত হয় নি। এর ভিত রচিত হয়েছে সেই বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে। রচিত হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেন, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং তারও আগে ক্ষুদিরাম বসুদের সময় থেকে।
জলপাই রঙের কেন্দ্রভূমি পটিয়া। চট্টগ্রামের পটিয়া, বিটিশবিরোধী বিপ্লবের স্মৃতিবিজরিত এই সেই পটিয়া। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতার গ্রাম। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে গল্প বলতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চলে এসেছেন তারা। লেখকের কলমের খোঁচায় জীবন্ত হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে।
এই আখ্যানে সূর্যসেন আর প্রীতিলতার ঘটনা মর্মকে স্পর্শ করে গভীরভাবে। সেই তরুণত্রয়কে তাদের আংকেল নিয়ে যায় পটিয়ার গৈরলা গ্রামেরই এক বাড়িতে। ক্ষীরদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়ি। যেখানে মিশে আছে সূর্যসেনের স্মৃতি। এই বাড়ির পাশেই বাঁশবাগানে শুকনো বাঁশপাতার ফাঁদে পড়ে ধরা পড়েন সূর্যসেন। যে সূর্যসেন দেশকে রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছেন, বিয়ে সংসার তাকে মানায় না। তার কাজ বৃটিশ বেনিয়াদের থেকে দেশকে রক্ষা করা। পুষ্পের সাথে বিবাহের প্রথম রাতে তার অনুপস্থিতি সেই স্বাক্ষরই বহন করে। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে সূর্যসেনের দূরদর্শিতা ভাবিয়ে তোলে সমগ্র ব্রিটিশ প্রশাসনকে।
চট্টগ্রামে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের জন্য সূর্যসেন দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচন করে প্রীতিলতাকে। বাঙ্গালী নারী প্রীতিলতা কিভাবে সেদিন দুর্বারগতিতে সেই ক্লাবে আক্রমণ চালিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন নিজের নাম, তার একটা বিস্তর বিবরণ পাওয়া যায় উপন্যাসের এই অংশে।
আছে হৃদয়বিদারক ঘটনার ঘনঘটা। যুদ্ধকালীন সময়ে একটি পরিবারের সুদীর্ঘ নয়মাস আটফিট বাই আটফিট ঘরে বন্দী জীবন, চরম খাদ্য সংকট, অসুস্থতা, দুর্বিষহ জীবনাচার প্রতিনিধিত্ব করে সেসময়ের যুদ্ধের ভয়াবহতা।
উপন্যাসের নায়ক সুজিতকে কেন্দ্র করে লেখক অবতরণ করিয়েছেন ছোট ছোট অনেকগুলো চরিত্রের। যেমন, গফুর,ইদ্রিস ডাক্তার, মনসুর দর্জি,পুর্নেন্দু কানুনগো প্রভৃতি। তাদের অবতরণ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও লেখনীতে তাদের ভূমিকা ছিল বেশ শক্তিশালী। ছোট ছোট শক্তিশালী এসব চরিত্র গল্পে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা।
যারা তাদের স্ব স্ব জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সাহায্য করে। এখানে গ্রাম্য ডাক্তার ইদ্রিসের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা আর দশজন প্রতিবাদী বাঙ্গালীর চরিত্রের স্বাক্ষর বহন করে। অন্যদিকে দর্জি মনসুরের খোলসের ভিতরে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙ্গালী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ।
আবার মুদ্রার আরেক পিঠে দেখতে পাই প্রিন্সিপাল হাওলাদার, ইউসুফ আর ইউপি মেম্বার রজব আলীর মত চরিত্রের। যারা এই দেশে জন্মগ্রহণ করে এই দেশের আলো,বাতাস, মাটি দিয়ে মানুষ হয়ে পক্ষ অবলম্বন করে পাকদের।
লেখক তার লেখনীতে কখনো কখনো চমৎকার সব এপিগ্রামের আশ্রয় নিয়েছেন । যেমনটা পাই একেবারে শেষ অংকে-
সুজিতের ছেলে তার বাবাকে পাক হানাদারের কোট পরা নিয়ে বললে প্রত্যুত্তরে সে বলে,
‘লজ্জা কেন হবে? মানুষ তো পশুকে মেরে তার চামড়া পরে, তাতে কি কোন লজ্জা হয়?’
ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখক অত্যন্ত সহজ, সরল ও প্রাঞ্জলভাবে একটার পর একটা ঘটনা বর্ণনা করে গেছেন নির্মোহ ভঙ্গিতে। এই বর্ণনা লেখনীর গভীরে ঢুকে যেতে ব্যাপক সহায়তা করেছে। মনে হয়েছে যেন ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঘটছে আর আমি তা বার্ডস আই ভিউ- এ পর্যবেক্ষণ করছি। ভাষার ব্যবহার, বাক্যের গঠন, দৃশ্যায়ন, চরিত্র উপস্থাপনে যে সাবলীলতার পরিচয় লেখক দিয়েছেন এখানে, এটাই এই উপন্যাসের মূলশক্তি।
সামান্য কিছু অসঙ্গতিও ধরা পরে। বেশ কিছু জায়গায় বানানের ভুল চোখে পরে। লাইন স্পেসিং-এ সামান্য ঝামেলা লক্ষ্যনীয়। পরের সংস্করণে নিশ্চয়ই এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া হবে।
আমাদের দেশে ইতিহাস নির্ভর বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্যের সংখ্যা কম। এক্ষেত্রে জলপাই রঙের কোট-উপন্যাসটি সে সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বইটি লেখককে শক্তিশালী একটি জায়গা করে দেবে তা নি:সন্দেহে বলা যায়। রবিউল করিম মৃদুল নতুনের বার্তা নিয়ে আসছেন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। তার জায়গা তিনিই করে নেবেন।
– সাজেদুর রহমান সুমন
Leave a reply