পটুয়াখালী প্রতিনিধি:
চলতি বছরে কুয়াকাটা সৈকতে মোট ২১টি মৃত্যু ডলফিন ভেসে এসেছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। বিষয়টি পরিবেশের জন্যও হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
এদিকে গত বছর জেলা প্রশাসকের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে ডলফিন মৃত্যুর সঠিক কারণ আজও সবার অজানা।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য আবুল হোসেন রাজু জানান, বৃহস্পতিবার সকালে জোয়ারের পানিতে কুয়াকাটার গঙ্গামতি চরের তেত্রিশকানি সংলগ্ন সৈকতে একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। এখানে ভাঙ্গাগাছের গোড়ায় ডলফিনটি আটকে পড়ে। এটির দৈর্ঘ্য পাচ ফুট। এর শরীরেও আঘাতের চিহ্ন আছে। স্থানীয় জেলেরা ডলফিনটি দেখে আমাদের খবর দিলে আমাদের কমিটির সদস্যরা গিয়ে সেটি মাটি চাপা দেয়।
ডলফিন রক্ষা কমিটির আরেক সদস্য কে এম বাচ্চু জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর সকালে সৈকতের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন সানসেট পয়েন্টে একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। তার আগের দিন ৮ সেপ্টেম্বর সকালে সৈকতের গঙ্গামতি এলাকায় ছয় ফুট লম্বা একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। একইদিন দুপুরে জিরো পয়েন্টর পশ্চিম পাশে আরো একটি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছিলো। ডলফিনগুলো কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্যদের সহায়তায় উদ্ধার করে মাটি চাপা দেয়া হয়। ৯ তারিখে যে ডলফিন ভেসে এসেছে তার নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর মোট ২১টি মৃত ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসে।
এর আগে শুধু আগস্ট মাসেই সৈকতে ১০টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। ২০২০ সালে কুয়াকাটা সংলগ্ন উপকূলে ভেসে এসেছিল মোট আটটি মৃত ডলফিন। যেগুলো মাটি চাপা দেয়া হলেও মারা যাবার প্রকৃত কারণ এখন উদঘাটন করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
তবে এসব ডলফিন কী কারণে মারা যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান না করেই মাটি চাপা দেয়ার বিষয়টি মানতে পারছেন না স্থানীয়রা। তাদের মতে, ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ জেনে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সৈকতে ভেসে আসা মৃত জলজ প্রাণিগুলোর মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করে অ্যাকুয়ারিয়াম কিংবা জাদুঘরে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এসব মৃত ডলফিনের অধিকাংশেরই লেজ থাকে জালে পেচানো। আবার কিছু কিছু ডলফিনের মুখমণ্ডলে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। কিছু কিছু ডলফিন প্রায় অর্ধগলিত অবস্থায় সৈকতে এসে পৌঁছায়।
এ ব্যপারে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, কী কারণে ডলফিন মারা যাচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এগুলো সংরক্ষণ করে মৃত্যুর কারণ বের করতে মৎস্য ও বন বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ডলফিন মৃত্যুর কারণ তদন্তে যে ধরনের মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও লোকবল থাকা দরকার তা মৎস্য অধিদপ্তরের নেই। যে কারণে এগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। কোনো উপায় না থাকায় মৃত ডলফিনগুলো মাটি চাপা দিতে বলা হয়েছে স্থানীয়দের।
গত বছর মৃত ডলফিন ভেসে আসার ঘটনায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছিলো। ওই তদন্ত টিমে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা মৎস্য অফিসার, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নাম ছিল। এক পর্যায়ে তারা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে মোট পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা হয়।
কারণগুলো হলো-মেকানাইজড ভ্যাসেলের বেহুন্দি জালে আটকা পরে, মেকানাইজড জাহাজের ফ্যানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে, রাক্ষুসে সামুদ্রিক প্রাণীর আক্রমণে, সামুদ্রিক দূষণ এবং প্রাকৃতিক কারণে। এই পাঁচটি কারণের মধ্যে শুধু সামুদ্রিক দূষণের বিষয়টি সুস্পষ্ট উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুনগত মান ভাল ও গ্রহনযোগ্য মাত্রায় ছিল। এতে বোঝা যায় যে, ডলফিন পানির পরিবেশ নষ্ট বা বিষক্রিয়ায় মারা যায়নি। বাকি চারটি কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা হয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতের উপর ভিত্তি করা ‘মেকানাইজড ভ্যাসেলের বেহুন্দি জালে আটকা পরা এবং মেকানাইজড জাহাজের ফ্যানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে’ ডলফিন মরা যাওয়া। অর্থাৎ গভীর সাগরে মাছ শিকারে পেতে রাখা বড় জালে এসব ডলফিন আটকে পরে মারা যেতে পারে অথবা সাগরে বড় বড় জাহাজের পাখায় ধাক্কা খেয়েও মারা যেতে পারে। কমিটির সুপারিশে এসব মৃত ডলফিন পোস্টমর্টেমের কথা উল্লেখ থাকলেও আজ অবদি তা করা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, এসব পোস্টমর্টেম বনবিভাগ আর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের করার কথা। জেলা মৎস্য অফিসের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। আমরা তাদেরকে বলেছি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
এব্যপারে বিভাগীয় বনকর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ডলফিন মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও অজানা। মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে মৃত ডলফিনের স্যাম্পল সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়া গেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
খেপুপাড়া মৎস্য গবেষণা ইানস্টিটিউটের সাথে যোগাযোগ করা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। ডলফিন নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত অপরদিকে মৎস্য অধিদপ্তর বরিশালের সাসটেইনাবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক মো. কামরুল ইসলাম জানান, ভেসে আসা এসব ডলফিন বঙ্গোপসাগরের অগভীর অঞ্চলে বসবাস করে। ২০/২৫মিনিট পরপর এরা অক্সিজেন সরবরাহের জন্য পানির উপরে আসে। তখনও এরা দূর্ঘটনার শিকার হতে পারে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
ইকোফিশ-২ প্রকল্পের সহকারী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি জানান, মৃত ডলফিনের অন্ত্রের একটি অংশ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এবং অপর একটি অংশ বন অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডলফিনটির মারা যাওয়ার প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে তিনি আশা করেন।
Leave a reply