ভূমিকম্পে যা করবেন, যা করবেন না

|

ভূমিকম্পে যা করবেন, যা করবেন না। ছবি: সংগৃহীত।

ভূমির আকস্মিক কম্পনই ভূমিকম্প। পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো অংশের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের ফলে কিংবা ভূ অভ্যন্তরের একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসলে ভূমিকম্প হয়। এছাগা, ভূ-অভ্যন্তরের স্থিত গ্যাস যখন ভূ-পৃষ্ঠের ফাটল বা আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তখন সেই গ্যাসের অবস্থানটি ফাঁকা হয়ে পড়ে আর পৃথিবীর উপরের তলের চাপ ওই ফাঁকা স্থানে দেবে গিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে। তখনই ভূ-পৃষ্ঠে প্রবল কম্পনের অনুভব হয়।

সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে—ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন জনিত কারণে, আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হওয়ার কারণে ও শিলাচ্যুতিজনিত কারণে।


ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব সাধারণত কয়েক সেকেন্ড হয়ে থাকে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যেতে পারে প্রলয়কাণ্ড। ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার নাম রিখটার স্কেল। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। এই স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানেই ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা—৫ – ৫.৯৯ হলে তা মাঝারি, ৬ – ৬.৯৯ তা তীব্র, ৭ – ৭.৯৯ তা ভয়াবহ এবং ৮-এর উপর তা অত্যন্ত ভয়াবহ বলে বিবেচনা করা হয়।

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বা প্রেডিকশন খুবই জটিল। আমরা কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্পকে সরাসরি নির্ণয় করতে পারি না, কিন্তু মাইক্রোসিসমিসিটি গবেষণা, ফোকাল ম্যাকানিজম গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য পূর্বাভাস এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, হাইসিসমিসিটি, লোসিসমিসিটি নির্ণয় করতে পারি, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি রোধে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ভূমিকম্পের জন্য শীর্ষ ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় থাকায় নাগরিকদের ভূমিকম্প সচেতনতা জরুরি।


ভূমিকম্পের আগে করণীয়:

১। বাড়ি বা কর্মক্ষেত্রের ভেতরে ও বাইরে নিরাপদ স্থানগুলো চিহ্নিত করুন, যেন ভূমিকম্পের সময় ভাবতে না হয় কোথায় আশ্রয় নেবেন। সে স্থানের আশপাশে যেন উঁচু কোনো ফার্নিচার বা গায়ে পড়ার মতো জিনিস না থাকে।

২। অন্ধকারে দেখার জন্য হাতের কাছে টর্চ রাখুন। এছাড়া বাড়িতে মই, শক্ত দড়ি, হেলমেট, হুইসেল, ফার্স্ট এইড বক্স রাখুন।

৩। শুকনো খাবার ও জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম হাতের কাছে রাখুন।

৪। ভূমিকম্পে গড়িয়ে পড়ার মতো আলগা জিনিস সব সময় বন্ধ শেলফে রাখা উচিত। শেলফগুলো ভালোভাবে দেয়ালের সঙ্গে আটকে রাখুন যেন এগুলো পড়ে না যায়। ভারী মালপত্র শেলফের নিচের দিকে রাখুন। ঝাঁকুনিতে যেন এগুলো গায়ের ওপর না পড়ে।

৫। দেয়ালে ঝোলানো ছবি, আয়না ইত্যাদি বিছানা থেকে দূরে রাখুন।

৬। গ্যাস ও বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি নিরাপদ রাখুন। লিক হওয়া গ্যাসলাইন, বৈদ্যুতিক লাইন মেরামত করে নিন এবং নিয়মিত পরীক্ষা করুন। এগুলোর চাবি কোথায় আছে এবং কীভাবে বন্ধ করতে হয় তা শিখে নিন।

৭। মাঝে মাঝে ভূমিকম্প ও জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার মহড়া দিন, যাতে সবাই আয়ত্ত করতে পারে।


ভূমিকম্পের সময় করণীয়:

ভূমিকম্পের সময় বাড়ির ভেতর থাকলে-

১. ড্রপ, কাভার ও হোল্ড অন পদ্ধতিতে মেঝেতে বসে পড়ুন, কোনো মজবুত আসবাবের নিচে আশ্রয় নিন এবং কিছুক্ষণ বসে থাকুন। হেলমেট পরে বা হাত দিয়ে ঢেকে মাথাকে আঘাত থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করুন।

২. বিছানায় থাকলে মাথা বাঁচাতে বালিশ ব্যবহার করুন। ঘরের ভেতরের দিকের দেয়ালের কাছে বসে আশ্রয় নিতে পারেন।

৩. বাড়ির বাইরের দিকের দেয়াল বা কাচের জানালা বিপজ্জনক। এগুলো থেকে দূরে থাকুন।

৪. বহুতল ভবনের ওপরের দিকে অবস্থান করলে ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত ঘরের ভেতরে থাকাই ভালো।

৫. ভূকম্পন থেমে গেলে বের হয়ে আসুন।

৬. নিচে নামতে চাইলে কোনোভাবেই লিফট ব্যবহার করবেন না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামুন।


বাড়ির বাইরে থাকলে-

১. খোলা জায়গা খুঁজে আশ্রয় নিন। বহুতল ভবনের প্রান্তভাগের নিচে বা পাহাড়-পর্বতের নিচে কোনোভাবেই দাঁড়াবেন না। ওপর থেকে খণ্ড পড়ে আহত হতে পারেন।

২. লাইটপোস্ট, বিল্ডিং, ভারী গাছ অথবা বৈদ্যুতিক তার ও পোলের নিচে দাঁড়াবেন না।

৩. রাস্তায় ছোটাছুটি করবেন না। মাথার ওপর কাচের টুকরো, ল্যাম্পপোস্ট অথবা বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

৪. চলমান গাড়িতে থাকলে গাড়ি থামিয়ে খোলা জায়গায় পার্ক করে গাড়ির ভেতরেই আশ্রয় নিন।

৫. কখনোই ব্রিজ, ফ্লাইওভারে থামবেন না। বহুতল ভবন কিংবা বিপজ্জনক স্থাপনা থেকে দূরে গাড়ি থামান।


ভূমিকম্পের পরে করণীয়:

১. ভূমিকম্প শেষ হলেও আরো কম্পনের জন্য প্রস্তুত থাকুন। বড় ভূমিকম্পের পর আরো কিছু ছোট ভূকম্পন হবার সম্ভাবনা থাকে।

২. কম্পন থেমে গেলেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, তারপর বের হোন। ওপর থেকে ঝুলন্ত জিনিসপত্র কিছুক্ষণ পরও পড়তে পারে।

৩. নিজে আহত কি না পরীক্ষা করুন, অন্যকে সাহায্য করুন। বাড়িঘরের ক্ষতি পর্যবেক্ষণ করুন। নিরাপদ না হলে সবাইকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে যান।

৪. গ্যাসের সামান্যতম গন্ধ পেলে জানালা খুলে বের হয়ে যান এবং দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করুন।

৫. কোথাও বৈদ্যুতিক স্পার্ক চোখে পড়লে মেইন সুইচ বা ফিউজ বন্ধ করে দিন। ক্ষতিগ্রস্ত বিল্ডিং থেকে সাবধান থাকুন। অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।

৬. উদ্ধারকাজের জন্য নামতে হলে হেলমেট, হাতমোজা, জুতা, ফুলপ্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট এবং পর্যাপ্ত সরঞ্জামসহ নামুন যেন আপনার কোনো আঘাত না লাগে।

৭. ব্যাটারিচালিত রেডিও রাখুন যেন প্রয়োজনীয় খবর শোনা যায়।

৮. আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখুন। ফায়ার সার্ভিসের ফোন নম্বর রাখুন।


ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে করণীয়:

১. আগুন জ্বালাবেন না। বাড়িতে গ্যাসের লাইন লিক থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

২. ধুলাবালির মধ্যে পড়লে কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নিন।

৩. উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকুন। জরুরী অবস্থার জন্য রাখা জিনিসপত্র কাজে লাগান।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply