১৯৭৭ সাল। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। আমার বাবাকে তখন এই জেলখানায় নিয়ে এসে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ফাঁসি দেয়ার পর আমাদেরকে বাবার লাশটাও দেয়া হয়নি। তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে? এভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে নিজের বাবার কবর কোথায় জানতে চেয়েছেন বিমান বাহিনীর সাবেক সার্জেন্ট সাইদুর রহমান মিঞার ছেলে কামরুজ্জামান মিঞা লেলিন।
৪৪ বছর আগে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল লেলিনের বাবাকে।
জেলহত্যা দিবসে জাতীয় অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, তার পিতার মৃত্যুদিবস কবে সেটা তার কাছে অজানা। তার পিতার অপরাধ কি সেটা জানা যায়নি। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও জিয়াউর রহমানের সরকার তার বাবার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে মাটিচাপা দিয়েছে।
জেলহত্যা দিবসের অনুষ্ঠানে পরিত্যক্ত কারাগারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের আয়োজন করে কারা অধিদফতর। সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সন্তানসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগণ। অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মন্ত্রীকে ঘিরে ধরেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর সদস্যদের সন্তান ও স্বজনেরা। এসময় মন্ত্রীর নিকট দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করার চেষ্টাও করেন তারা। মন্ত্রীকে নিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চের কাছে। শেষে আন্দোলনকারীদের কাছে ১৯৭৭ সালের সেই ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে ফাঁসির তালিকা প্রকাশের আশ্বাস দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এই হট্টগোলের সময় উপস্থিত ছিলেন বিলকিস বেগম। তার বাবা আবুল বাশার ছিলেন বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট। ১৯৭৭ সালের ৩ অক্টোবর বিমান বাহিনীর ব্যারাক থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা লাশের সন্ধান করেছেন বহুবছর। কিন্তু বিলকিস বেগম এখনও জানেন না কোথায় তার বাবাকে দাফন করা হয়েছে। এতবছর পরে এসে পিতার ফাঁসির প্রক্রিয়ার তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
জেলহত্যা দিবসের অনুষ্ঠানে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের স্বজনদের সাথে ছিলেন বিদ্রোহের জড়িত থাকার অভিযোগ সাজাপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সদস্য। তাদেরই একজন রোজারিও গোমেজ। ১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ৫ বছর পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর দুই হাজার বন্দীর মুক্তির সাথে তিনিও কারামুক্ত হন।
রোজারিও জানান, তৎকালীন সময়ে সামরিক সরকার রাতের আঁধারে কারফিউ দিয়ে ফাঁসি কার্যকর করতো। কোনো প্রকার ধর্মীয় সৎকার ছাড়াই লাশগুলো আজিমপুর কবরস্থানে মাটিচাপা দেয়া হয়। দীর্ঘদিন পরিবারগুলোর কাছে এই তথ্য অজানা ছিল। আমরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই এবং রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষগুলোকে নির্দোষ হিসেবে দায়মুক্তি দেয়ার দাবি জানাই।
আন্দোলনকারীদের কথা শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের জানান, আমি শুনেছি অনেকের ফাঁসি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সম্পন্ন করার পর আজিমপুর কবরস্থানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিলো। নথিপত্র দেখে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
তবে ১৯৭৭ সালে ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দাবি আদায়ে আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। তারা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং সমাধি চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরিয়ে ফেলার দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকা বিমানবন্দরে জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায় বিমান বাহিনীর কিছু সদস্য এবং জাসদপন্থী বিপ্লবীরা। তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ফাঁসি দেয়া হয় সেনা ও বিমান বাহিনীর অসংখ্য সদস্যকে। ঢাকা ও কুমিল্লা কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এমন ১৯৩ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে জানা যায়, এই বিদ্রোহ দমনে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে মোট ১১৫৬ জনকে ফাঁসি দেয় তৎকালীন সরকার। যাদের বেশিরভাগ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
Leave a reply