ম্যাকমাস্টারকে সরিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে একজন যুদ্ধবাজ ও মুসলিম বিদ্বেষী জন বোল্টনকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ওভাল অফিসে যুদ্ধবাজ ও লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী জাতীয় নিরাপত্তার নিয়োগ এই প্রথম নয়। এর আগে ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, যার হাতে লেগে আছে ত্রিশ লাখ ভিয়েতনামবাসীকে খুনের রক্ত। কট্টর সাদা জাতীয়বাদী মতবাদে বিশ্বাসী নির্লজ্জ স্টিভ ব্যাননও এই তালিকা সহজে জায়গা করে নিবে।
তবে বোল্টন পুরো বিশ্বের জন্য তো বটেই খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যকার সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির জন্যও বড় ধরনের হুমকি।
বিপদজনক, অদূরদর্শী ও খেপাটে বোল্টন নব্যসংরক্ষণবাদী মতবাদে বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করেন, কূটনৈতিক আলোচনা নয়, চরমপত্র বা হুমকিই সমস্যা সমাধানের সর্বোকৃষ্ট পন্থা। তার মতবাদ অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে স্বার্থের সমর্থক হও অথবা মার্কিন সেনাদের মোকাবেলা কর।
জুনিয়র বুশের সাম্রাজ্যবাদী অভিলাসের একনিষ্ঠ ও সবচেয়ে কর্মদ্যোম সমর্থক ছিলেন বোল্টন। ২০০২ সালে স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে বুশ ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের অক্ষ’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। বুশের বক্তব্যকে আরও বেশি জোরালো করতে বোল্টন বলেছিলে, “এ অক্ষ নিজেদের মধ্যে বিপদজনক অস্ত্র ও প্রযুক্তি আদান-প্রদান করে থাকে।”
আমরা এখন জানি, বোল্টনের এই দাবি পুরোপুরি মিথ্যা।
শুধু ওই তিন দেশ নয়, দীর্ঘ দিনের সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবাকে নিয়েও তার মিথ্যাচারে অন্ত ছিল না। বোল্টন দাবি করেছিলেন, হাভানা জৈব-অস্ত্র তৈরি করছে। অথচ মার্কিন সিনেটের প্রধান জৈব-অস্ত্র বিশ্লেষক তার এই বক্তব্যকে একেবারেই আমলে নেননি।
তবে জুনিয়র বুশ তার কর্মকাণ্ডে বেজায় খুশি ছিলেন বলা যায়। ২০০৫ সালে বুশ তাকে জাতিসংঘে মার্কিন দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু এরপরই সিনেটের শুনানিতে বোল্টনের পাগলাটে ও উসাকানিসুলভ আচরণের বিষয়টি সবার সামনে চলে আসে।
তার সাথে কাজ করা মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকারের একজন কর্মী বলেন, “রাশিয়ার হোটেলে মিস্টার বোল্টন আমার পিছু লেগে ছিলেন। হোটেলে হল ঘরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জিনিস ছুঁড়তে থাকেন, দরজার নিচ দিয়ে হুমকি দেওয়া চিঠি পাঠাতেন। তিনি সাধারণত একজন পাগলাটে ব্যক্তির মতো আচরণ করেছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমার কোম্পানি ও ইউএস এআইডি থেকে দিক নির্দেশনার জন্য আমি প্রায় দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করি। জন বোল্টন ওই সময়টাতে এমন আতঙ্কজনকভাবে জ্বালাতন করতেন যে আমি হোটেল কক্ষে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। এরপর তিনি নিয়মিত আমার দরজায় আঘাত করতেন, এবং চিৎকার করে হুমকি দিতেন।”
হয়তো এটা ঠিক যে কোনো এক জনের সাক্ষ্যকে বাতিল করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অধীনস্থদের প্রতি বোল্টনের খেয়ালী ও আক্রমণাত্নক ব্যবহার একেবারে কম নয়। তার এ ধরনের ব্যবহারের বিষয়ে অর্ধ ডজন মানুষের সাক্ষ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।
বোল্টনের এ ধরনের ব্যবহার যে আর কারও মাঝে নেই বা ছিল না এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্ট হিসেবে ট্রাম্পের মতো একজন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পাশাপাশি মুসলিম বিদ্বেষীদের সাথে তার দহরম মহরমও খুবই আশঙ্কার বিষয়। উদারণস্বরূপ, সাউদার্ন পোভার্টি ল’ সেন্টার-এর(এসপিএলসি) পামেলা গেলারের সঙ্গে রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। পামেলা গেলারকে বলা হয়ে থাকে, ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি অপ্রকৃতিস্থ ও কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মার্কিন নাগরিক।’
২০১০ সালে বোল্টন আরেক কুখ্যাত মুসলিম বিদ্বেষী ও চরমপন্থী রবার্ট স্পেন্সারের সাথে যৌথভাবে একটি বই লিখেছিলেন। পরে এই বিষয়ে এসপিএলসি বলেছিল:
“স্পেন্সার অভিযোগ করেন, মুসলিমরা ‘শরীয়া ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী’ বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী, এবং সারা আমেরিকা তাদের সংখ্যা আরও বাড়বে। বারাক ওবামাকে প্রথম মুসলিম প্রেসিডেন্ট, এবং ‘চিরায়ত ইসলাম অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমোদন দেয়।’ ওই বইয়ে আরও বলা আছে, ‘চিরায়ত ইসলাম আধুনিক ও শান্তিপূর্ণ না’। এমনকি এটাও বলা হয়েছিল, অর্থে জন্য গণ মাধ্যম ইসলামকে ইতিবাচকভাবে দেখায়।”
নেশন ম্যাগাজিন বোল্টনের ওই বইটিকে, “বারাক ওবামার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের একটি সিরিজ এবং মুসলিম বিদ্বেসী বক্তব্য প্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ওই বইয়ের একটি প্যারায় দাবি করা হয়েছিল, ৪৪তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট আদতে একজন মুসলিম।”
মার্কিন মুল্লুকে ইসলামভীতির ছড়ানোর অগ্রদূত ফ্র্যাঙ্ক গ্যাফনিকে ২০১২ সালে একটি সাক্ষাৎকার দেন বোল্টন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি গ্যাফনির সাথে একমত হন যে মার্কিন সরকারের বিভিন্ন জায়গায় চুপিসারে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। ইসলামের প্রতি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের শপথের প্রতি অনুগত্যও দাবি করেন তারা।
২০১০ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে ইসলামী কমিউনিটি সেন্টার বিরোধী অতি ডানপন্থীদের একটি র্যালিতেও অংশ নিয়েছিলেন বোল্টন।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে বোল্টনের দায়িত্ব গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের অবস্থানকে আরও বেশি নাজুক করে তুলবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম অভিবাসীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, এবং যারা আছেন তাদের ব্যাজ পরিধানে বিষয়ে আইন প্রণয়নের আহবান জানিয়েছেন ট্রাম্প।
শুধু মার্কিন মুসলিম নয়, বোল্টনের বিদ্বেষের হাত থেকে মুসলিম দেশগুলোও নিরাপদ নয়। ইরান বোমা বর্ষণের অভিপ্রায়ও ইতিমধ্যে তিনি ব্যক্ত করেছেন। ২০১১ সালে গার্ডিয়ানে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন, “অপ্রীতিকার হলেও সত্য যে ইরানের পারমাণবিক সক্ষম অর্জনকে নস্যাৎ করতে হলে ইসরায়েল অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, অথবা উভয়কে দেশটিতে সেনা আক্রমণ চালাতে হবে।”
সবশেষে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন একজন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে তিনি কাজ করবেন। সম্পূর্ণ একা ও হতাশাগ্রস্থ ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ছাঁটাই করছেন।
সবকিছু মিলিয়ে বোল্টন বিপদজনক সময়ে একজন বিপজনক উপদেষ্টা, যিনি একজন বিপদনজনক প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করবেন।
যমুনা অনলাইন: এফএইচ
Leave a reply