আধুনিক এই যুগে যতই আপনি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়াবেন ততই বাড়বে ব্যক্তিগত তথ্য পাচার হবার শঙ্কা। মোবাইল কোম্পানি, অপারেটর, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, ওয়েবসাইট কিংবা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা…. সবারই সুযোগ রয়েছে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহেরর। সব কিছু বাদ দিন, শুধু ফেসবুক আর গুগলের কাছে আপনার কী পরিমাণ তথ্য আছে, জানলে নিজেই হকচকিয়ে যাবেন।
গুগল জানে আপনি কোথায় ছিলেন
যখনই আপনি মোবাইল ফোন চালু করছেন, গুগল জেনে যায় আপনি কোথায় আছেন। অবশ্য এর জন্য লোকেশন অপশনটি চালু থাকতে হয়। তবে, ফোন প্রথমবার সেট আপ করার সময় কিংবা বিভিন্ন অ্যাপের প্রয়োজনে বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই লোকেশন সার্ভিস অন রাখেন। মোবাইল ফোনে থাকা জিপিএস ব্যবহার করে আপনি কবে কখন কোথায় গিয়েছিলেন, সবকিছুর খুটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে রাখে গুগল। চাইলে আপনি নিজেরটাও দেখে নিতে পারেন, এই লিংকে ক্লিক করে…https://www.google.com/maps/timeline?pb
গুগল জানে আপনি কী সার্চ করেছেন, কী মুছে ফেলেছেন
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আপনি এ যাবতকালে যা যা সার্চ করেছেন প্রতিটি জিনিসের তথ্য রেখে দিয়েছে গুগল। আপনি যদি কখনও সেই সব তথ্য মুছেও ফেলেন, সেটা যে গুগলের সার্ভার থেকে মুছে গেছে, তার কোন প্রমাণ কি আছে? একটু নিজেই দেখে নিন আপনার খোঁজাখুজির ইতিবৃত্ত কীভাবে সংরক্ষণ করছে গুগল। https://myactivity.google.com/myactivity
বিজ্ঞাপনের জন্য আপনার প্রোফাইল তৈরি করে গুগল
আপনার অবস্থান, বয়স, পছন্দ অপছন্দ, ক্যারিয়ার, রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, সম্ভাব্য ওজন আর উপার্জন; এই সব তথ্যই পাওয়ার সুযোগ আছে গুগলের। সেই সাথে আপনি কি সার্চ করেছেন সেসব তথ্য তো আছেই। সেসবের ভিত্তিতে গুগল আপনার বিজ্ঞাপন প্রোফাইল তৈরি করে থাকে। যার কারণে অনেকই সময় দেখবেন, কোন একটা পেজে এমন সব বিজ্ঞাপন উঠে আসছে, যাতে আপনার আগ্রহ আছে, কিংবা সম্প্রতি আপনি এমন কিছু খুঁজে দেখেছেন। দেখে নিন নিজের প্রোফাইলটা https://google.com/settings/ads/
গুগল জানে আপনার অ্যাপসের অতীত ও বর্তমান
স্মার্টফোন (আইফোন ছাড়া) ব্যবহারের শুরুর থেকে আপনি এখন পর্যন্ত যে সমস্ত অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন সবকিছুর হিসাব আছে গুগলের কাছে। শুধু তাই নয়, কোন অ্যাপটি বেশি ব্যবহার করেন, কখন-কোথায় ব্যবহার করেন, কার সাথে যোগাযোগ করেন সবকিছুই জানে গুগল। এর অর্থ হলো আপনি ফেসবুকে কার সাথে আলাপ করছেন, কোন দেশের মানুষের সাথে কথা বলছেন এমনকি কখন ঘুমাতে যান তারও খবর আছে গুগলের কাছে।
ইউটিউবে কী ভিডিও দেখেছেন? জানে গুগল
ইউটিউবে যত ভিডিও দেখেছেন সবকিছুর তালিকা করে রেখেছে গুগল। সেই তালিকা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি জেনে যায়, আপনি রক্ষণশীল নাকি মুক্তমনা, আপনি মুসলিম, নাকি খ্রিষ্টান। খুব বিষন্নতায় ভুগছেন বা আত্মঘাতি হয়ে উঠতে যাচ্ছেন কিনা সেটাও বলে দিতে পারে গুগল, এমনকি খুব শিগগিরই আপনার ঘরে সন্তান আসছে কিনা সেটারও ধারণা নিতে পারে গুগল।
গুগলের কাছে আপনার লাখো তথ্য
আপনার যত তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছে, সেটা বান্ডেল করে ডাউনলোড করার সুযোগ দেয় গুগল। ব্যবহারের মাত্রা ভেদে এর পরিমাণ ২ গিগাবাইট থেকে ৫/৬ গিগাবাইট বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে। এর অর্থ আপনার নামে লাখ লাখ ডকুমেন্ট রয়েছে গুগলের কাছে। এসব ডকুমেন্টের মধ্যে আছে আপনার বুকমার্ক, ইমেইল, কনট্যাক্ট, গুগল ড্রাইভের ফাইল, ইউটিউবের ভিডিও, আপনার ফোন দিয়ে যত ছবি তুলেছেন, গুগলের মাধ্যমে যেসব পণ্য কিনেছেন…এমন আরও অনেক কিছু।
তাদের কাছে আপনার ক্যালেন্ডারের তথ্য, গুগল হাংআউটে যেসব আলাপ করেছেন, কখন কোন গান শুনেছেন, গুগল বুক থেকে যে বইটা কিনেছেন, গুগলের যেসব গ্রুপের আপনি সদস্য, যেসব ওয়েবসাইট আপনি তৈরি করেছেন, এখন পর্যন্ত যেসব ফোন ববহ্যার করেছেন, যেসব পেজ আপনি শেয়ার করেছেন, এমনকি দিনে আপনি কয় কদম হেটেছেন সেটাও রয়েছে গুগলের কাছে। জেনে নিন আপনার কী পরিমাণ তথ্য রয়েছে গুগলের কাছে। https://google.com/takeout
গুগলের খবর তো অনেক হলো, এবার একটু দেখা যাব বিশ্বের সবচেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কি করছে?
গুগলের মতো ফেসবুকও আপনার নামে জড়ো করা সব তথ্য ডাউনলোডের সুযোগ দেয়। সেখানেও রয়েছে হাজার হাজার ডকুমেন্ট। ফেসবুকে যাত্রা শুরুর পর যত মানুষকে যত মেসেজ করেছেন, যত মেসেজ পেয়েছেন, যত ফাইল পাঠিয়েছেন বা গ্রহণ করেছেন সবই রয়েছে এখানে। আপনার ফোনের সব কনট্যাক্ট নাম্বার এমনকি অডিও বার্তাও রেখে দিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
ফেসবুকও আপনার সব কর্মকাণ্ডের খবর রাখে
আপনার প্রতিটি লাইক যাচাই করে ফেসবুক। বন্ধুদের সাথে কি নিয়ে আলাপ করছেন সেটাও বুঝে নিয়ে সে ধারণা পায় কিসে আপনার আগ্রহ। সেই মোতাবেক ফেসবুক আপনার অনেক তথ্য সংগ্রহ করে রাখে। মেসেঞ্জারে গল্পগুজব করার সময় যত রকমের স্টিকার আপনি পাঠিয়েছেন, তার প্রতিটির হিসাব আছে ফেসবুকের কাছে। (এটা কিসে কাজে লাগবে, সেটা ফেসবুকই জানে।)
আপনি কখন ফেসবুকে লগইন করছেন, কোথা থেকে, কখন এবং কোন ডিভাইস দিয়ে করছেন, সবই সংরক্ষণ করে রাখে ফেসবুক। এখন পর্যন্ত যত অ্যাপ আপনি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যবহার করেছেন সেটারও খতিয়ান রয়েছেন সাইটটির কাছে। তাই তারা বুঝে নিতে পারে, রাজনীতিতে নাকি ওয়েব এন্ড গ্রাফিক্স ডিজাইনেই আপনার আগ্রহ বেশি।
ওয়েবক্যাম আর মাইক্রোফেনেও ফেসবুকের খবরদারি!
আপনি কোথায় আছেন, কি অ্যাপ্লিকেশন ইন্সটল করেছেন, কখন এবং কী প্রয়োজন তা ব্যবহার করেছেন, আপনার কনট্যাক্ট, ইমেইল, ক্যালেন্ডার, মেসেজ আদান প্রদান, ফটো, ভিডিও, মিউজিক, কল-সার্চ-ব্রাউজিংয়ের তথ্য, কোন রেডিও স্টেশন শুনেন, তারও খবর সংরক্ষণ করে ফেসবুক। এমনকি যে কোন সময় আপনার ওয়েবক্যাম আর মাইক্রোফোনেও প্রবেশ করার সক্ষমতা রয়েছে ফেসবুকের।
পরিশেষে
এসব তথ্য অপব্যবহারের কিন্তু হাজারটা উপায় রয়েছে। আপনি বলছেন, আপনি কোন জঙ্গি নন। তাহলে গুগলে ISIS সার্চ করেছিলেন কেন? স্ত্রীকে সন্দেহ করেন? কৌশলে তার গুগল অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে দেখে নিলেন, গত ১০ বছরে তিনি কোথায় কোথায় গেছেন। কোনভাবে কারো অ্যাকাউন্টের অনুপ্রবেশের সুযোগ পেলেন, তো তার জীবনের পুরো দলিল দস্তাবেজ আপনার সামনে খুলে গেলো। যা ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে আপনি তাকে বেকায়দায় ফেলতে পারবেন।
এমনই এক অদ্ভুত আধুনিক যুগে বাস করছি আমরা। সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান যদি আপনার বাসার ভেতরে সিসি ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন বসায়, তা কি আপনি মেনে নিবেন? কখনই না। কিন্তু আমরা যে তার চেয়েও এক কাঠি সরেস, নিজের পকেটের টাকা খরচ করে, নিজ থেকেই সেইসব কাজ করে দিয়েছি।
Leave a reply