বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকের মনে থাকে না। কিন্তু কেউ কেউ মনে রেখে বড় ধরনের কোনো মজা করে বসেন কারও কারও সাথে। ঘটনার আকস্মিকতা কাটতেই বলে ওঠেন, এপ্রিল ফুল! যত নিষ্ঠুরই আর নির্মম হোক, এই দুই শব্দেই বৈধ হয়ে গেলো বোকা বানানোর সব আয়োজন। তখন মনে পড়ে, হ্যাঁ আজকে এপ্রিলের প্রথম দিন।
এই দিনে কাউকে বোকা বানানোর ব্যাপারটি কমবেশি সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত রয়েছে। বিশেষত, খ্রিস্টান ধর্মলম্বী অধ্যুষিত পশ্চিমা বিশ্বে। কিন্তু দিবসটি পালনের পেছনে কী ইতিহাস আছে, সে ব্যাপারে কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। দেশে দেশে নানা রকম মিথ প্রচলিত আছে এপ্রিল ফুল দিবস নিয়ে।
পশ্চিমা সংস্কৃতির অংশ হলেও এপ্রিল ফুল নিয়ে মুসলিম বিশ্বেও প্রচলিত রয়েছে নানা মিথ আর তত্ত্ব। এগুলো এতটাই আকর্ষণীয় যে বেশিরভাগই মানুষই তা বিশ্বাস না করে পারেন না। একেক দেশে একেক রকম গল্প প্রচলিত রয়েছে। এই মিথগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচনা করে দেখা যাক।
গ্রানাডার পতন ও খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র:
মুসলমান শাসিত অন্যতম ঐশ্বর্যময় শহর স্পেনের গ্রানাডা। উম্মাইয়া খলিফারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও স্থাপত্যের নজর কাড়া সব নিদর্শন রেখে গেছেন শহরটিতে। হাজার বছর আগে গ্রানাডার মুসলমানরা ছিল অপরাজেয়।
এপ্রিল ফুল নিয়ে প্রচলিত প্রথম গল্পটা এখানকারই। ১৫ শতকের শেষভাগে স্পেনের খ্রিস্টানরা যখন দেখল, যুদ্ধে কোনভাবেই তারা মুসলমানদের হারাতে পারবে না, তখন তারা ভিন্ন পন্থা বেছে নিলো। গ্রানাডার শাসকদের কৌশলে মদ ও তামাকে আসক্ত করলো। নেশায় বুদ মুসলিমদের বেকায়দায় পেয়ে ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল তাদের দুর্গটি দখল করে নেন তৎকালীন ক্যাস্টিল রাজ্যের শাসক ফার্ডিনান্ড-ইসাবেলা। সেইদিন তারা ‘এপ্রিল ফুল’ পালন করেছিল। কেননা, মুসলমানদের বোকা বানাতে খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র কাজে লেগেছিল।
ফ্যাক্ট:
কিন্তু সত্য ঘটনা হলো মুসলমানরা আত্মসম্পর্ণ করেছিল ১ এপ্রিল নয়; ১৪৯২ সালের ১২ই জানুয়ারি। এখানেই শেষ নয়, তামাকের সাথে ইউরোপবাসী পরিচিত হয় গ্রানাডায় মুসলিমদের পরাজয়ের বেশ কিছু বছর পর। আর মদ, তার সাথে তো বহু আগে থেকেই মুসলমানরা পরিচিত।
স্প্যানিশদের দ্বারা মুসলিম হত্যাযজ্ঞ:
আরেকটি মিথ হচ্ছে, ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের পর মুসলমানদের জাহাজে করে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ওই জাহাজগুলোর পরিচালনায় ছিল স্প্যানিশরা। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, কারো দ্বারা মুসলমানদের কোন ক্ষতি হতে দেবে না। কিন্তু জাহাজগুলো মাঝ সমুদ্রে পৌঁছালে স্প্যানিশরাই সকল মুসলমানকে হত্যা করেছিল।
ফ্যাক্ট:
মুসলমানদের স্পেন ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল ১৬০৯ সালের পর। অর্থাৎ গ্রানাডার পতনের পর স্পেন থেকে মুসলিমদের ১ এপ্রিল নিরাপদ দেশ ত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও হত্যা করা হয়েছিল, এমন প্রচলিত ধারণাটির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
বাহদুর শাহ জাফরকে তার পুত্রের খুলি উপহার:
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহদুর শাহ বা বাহদুর শাহ জাফরকে বন্দি করে তৎকালীন বার্মা তথা মিয়ানমারে নির্বাসন দিয়েছিল। গল্প প্রচলিত রয়েছে যে, ১ এপ্রিল বাহদুর শাহ জাফরকে নাস্তা হিসেবে তার ছেলের খুলি দেওয়া হয়েছিল; এবং এটি ছিল মেজর হাডসনের ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন।
ফ্যাক্ট:
এটা সত্য যে বাহাদুর শাহ জাফরকে তার ছেলের খুলি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটি ছিল নওরোজ উৎসবের সময়। পারস্য নববর্ষ বা নওরোজ সাধারণত মার্চের ২১ তারিখে শুরু হয়। এটা হতে পারে যে তখনকার দিনের পরিবহন ব্যবস্থার কারণে মাথার খুলিটি আসতে কয়েক দিন দেরি হয়েছিল। কিন্তু তাহলেও এটি নওরোজ সম্পর্কিত; ‘এপ্রিল ফুল’-এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
আসলে ‘এপ্রিল ফুল’ কী?
একটি কিংবদন্তী অনুসারে বলা হয়, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্স তাদের ক্যালেন্ডার চেঞ্জ করে। এর আগে বছর শুরু হতো মার্চের শেষে। কিন্তু এটা এগিয়ে নিয়ে আসা হয় আর বছর শুরু করা হয় ১ জানুয়ারি থেকে। কিন্তু নতুন এই পরিবর্তন অনেকেই মানতে পারলেন না। তারা এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন যে, ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত তারা আগের মতোই নববর্ষ পালন করবে। কিন্তু যারা পরিবর্তন গ্রহণ করেছিল তারা ওদের সাথে মজা লুটতে চাইল। যারাই তখন নববর্ষ করতে চেয়েছে তাদের পিঠে পেপার ফিশ (Paper Fish) লাগিয়ে দিয়েছে। সেই তখন থেকে ভিক্টিমদের বলা হতো Poisson d’Avril বা এপ্রিল ফিশ।
কোথাও কোথাও প্রচলিত রয়েছে যে, হযরত নূহ (আঃ) যখন দেখলেন পানি কমছে না, তখন তিনি একটি কবুতর পাঠান দেখার জন্য কবুতর ফিরে আসে কিনা। ফিরে আসলে সেটা হবে ডাঙ্গা খোঁজার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ডাঙ্গা পেলে কবুতর ফিরবে না। কিন্তু কবুতর ফিরে এল। নূহ (আঃ) ‘বোকা’ বনে গেলেন। এটা স্মরণ করে এপ্রিল ফুল পালন করা হতো।
জার্মানদের মধ্যে প্রচলিত আছে এমন একটা গল্প- ১৫৩০ সালের ১ এপ্রিল জার্মানির অগসবুর্গ শহরে একটা আইন বিষয়ক মিটিং হবার কথা ছিল। এই মিটিং এর ফলাফল নিয়ে মানুষ অনেক টাকা বাজিকরের কাছে জমা রাখে। শেষ পর্যন্ত মিটিং হয়নি। কিন্তু বাজিকর টাকা ফেরত দেয়নি। সব টাকা গচ্চা যায়। এই বোকামি একটা উৎস হতে পারে এপ্রিল ফুলের।
কিন্তু এসব ঘটনা থেকেই যে ‘এপ্রিল ফুল’-এর প্র্যাংক বা বোকা বানানোর বিষয়টি এসেছে সেটিও শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ নয়। এমনকি এই তত্ত্ব নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তবে একটি বিষয় পরিস্কার যে, মুসলিমদের বোকা বানিয়ে খ্রিস্টানরা ১ এপ্রিল তাদের হত্যা করেছিল, এমন তথ্যের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
নানা মিথের ওপর গড়ে ওঠা ‘এপ্রিল ফুল’ পালনের যে সংস্কৃতি তা অনেক সময় সীমা অতিক্রম করে। অপরকে বোকার বানাতে গিয়ে এমন সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা কখনও কখনও বিরক্তি এবং অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। আবার কখনও এ ধরনের প্র্যাংক বা বোকা বানানোর ‘নিতান্তই মজার’ কাণ্ড থেকে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
তবে এপ্রিল ফুল দিবস পালন থেকে বিরত থাকার সবচেয়ে বড় যুক্তিটি হলো, এভাবে মানুষকে বোকা বানাতে, মিথ্যা বলতে হয়। মিথ্যা, সেটাই মিথ্যাই। যতই নিস্পাপ হোক না কেন।
যমুনা অনলাইন: এফএইচ
Leave a reply