গল্পরা আঁকিবুকি করছে প্রতিটি চোখে। শরীরের একেকটি অঙ্গ সাক্ষ্য দিচ্ছে একেকটি ঘটনার। ভয়, ক্লান্তি, ক্ষুধা, বিষাদ, অবসাদ, জখম এবং অবশেষে সীমান্ত পাড়ি দিতে পেরে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার এক নিশ্চিন্ত অনুভূতি। একটি আত্মা যেন বয়ে বেড়াচ্ছে একটি করে উপন্যাসের উপজীব্য। এত এত গল্পের মাঝে কোনটি বর্ণনার জন্য বাছাই করা যায়? কোন আশ্রয়প্রার্থীর গল্পটি বলা বেশি দরকার? কোন ঘটনাটি সবচেয়ে করুণ? উখিয়া-টেকনাফে গত কয়েকদিন কাটানো কোনো সাংবাদিকদের পক্ষে এসব প্রশ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার উপায় নেই। প্রতিটি গল্পই করুণ। প্রতিটি ঘটনাই মর্মস্পর্শী। প্রতিটি অভিজ্ঞতাই চোখ ভেজানো।
এমন হাজারো ঘটনার মধ্য থেকে কিছু ঘটনা সংক্ষেপে জানাচ্ছেন কদরুদ্দীন শিশির–
ক্রাচে ভর করে খোঁড়ানো এক কিশোর
ক্রাচে ভর করে সড়কে হাঁটছিলো কিশোর একটি ছেলে। হাঁটছিলো বললে মারাত্মক ভুল হবে; খোঁড়াচ্ছিল। ডান পা-টি কোমর অবধি নেই। ডান হাতের নিচের ক্রাচে ভর দিয়ে বাম হাতেরটিকে হালকা করে ধরে কয়েক সেকেন্ড পর পর এক কদম এগোয়। বামের ক্রাচটিতে পুরো ভর দিতে পারছে না। এক পা সামনে ফেলে ডানে-বায়ে একবার তাকায়। আবার পা ফেলে, আবার একটু জিরোয়। আশেপাশে তাকায়। কাকে যেন খুঁজছে। কিছু হয়তো খুঁজছে।
এমন শারিরীক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এমন দ্বিধান্বিত চলাফেরা খুব স্বাভাবিকভাবেই যে কারো দৃষ্টি কাড়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হল কুতুপালং এলাকাটি গত কিছু দিনে একেবারে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে। ওখানে কিছুই আর স্বাভাবিক নেই। সর্বত্র অস্বাভাবিকতা। কাজকর্ম সব নিয়মের উর্ধ্বে উঠে গেছে। কোথাও কোনো নিয়ম খাটে না। ফলে কিশোর ছেলেটির চলাফেরার অস্বাভাবিকতায় কারোই ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার প্রতিবন্ধকতা, অসহায়ত্ব আর দ্বিধা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। অন্যরা চলছে নিজ নিজ অসহায়ত্ব আর বেদনা নিয়ে।
কিছুক্ষণ তাকে এভাবে দেখে হাতে ইশারা করলাম। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম সে লক্ষ্য করেছিলো আগেই। ইশারা দিয়ে তার দিকে আগ্রহ নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি দেখে সে দ্বিগুণ আগ্রহভরে তাকালো। ‘তুমিও বার্মা থেকে আসছো?’ প্রশ্ন করতেই মাথা সামনে পেছনে ঝাঁকিয়ে বললো, ‘জ্বি, আই বর্মাত্তন আইয়ে। আঁর বারি তমবাজার।’ ‘নাম কি তোমার? পায়ে কী হইছিলো? তুমি কি আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবা?’
সে তো হাতে আসমান পেয়েছে! কোনো বাংলাদেশি আগ্রহ নিয়ে তার সাথে কথা বলতে এসেছে, জানতে চাচ্ছে তার পায়ে কী হয়েছিল। এতেই সে খুশি। চেহারা থেকে আগের দ্বিধাটুকু কেটে গেল। বেশ ভালই বাংলা বলছে। আরাকানি টান থাকলেও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার কথা। রাস্তা থেকে একটু দূরে গিয়ে তাকে নিয়ে বসলাম। নাম জানালো মো. জুবায়ের। বয়স ১৭। ‘বাংলাদেশে এর আগে আসছিলা কখনো?’ জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘জ্বি এতদিন তো এখানেই ছিলাম!’
‘তুমি না বললা বার্মা থেকে এসেছো?’ ‘জ্বি স্যার, কালকে বার্মা থেকে আসছি। কিন্তু তার দুই মাস আগে বাংলাদেশে ছিলাম।’ জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশে কেন এসেছিলো। জুবায়ের জানালো, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশের ওপর হামলার পর মুসলিমদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ মিলে গ্রামে গ্রামে তাণ্ডব চালায়। সাথে ছিল মগরাও। একদিন তাদের গ্রামে ঢুকেও নির্বিচারে গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন আরও অনেকে। বিশেষ করে পুরুষ ও কিশোরদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় স্থানীয় মগ সন্ত্রাসীরা। বাবার সাথে বাড়ি থেকে পালানোর সময় ডান হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয় জুবায়ের। এরপর কোনো মতে বাবা তাকে বয়ে নিয়ে আসেন বাংলাদেশ সীমান্তে। উখিয়ার একটি হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও অপারেশনে অনেক টাকা লাগবে তাই সেখানে ভর্তি হতে পারেনি জুবায়ের। হাড্ডি ভাঙা হাঁটু নিয়ে মাস দুয়েক কক্সবাজারের রাস্তায় রাস্তায়, বিভিন্ন মসজিদের গেটে ভিক্ষা করেন বাবা ছেলে। এরপর কিছু টাকা জমা হলে সেটা নিয়ে কক্সবাজারে হাসপাতালে যান তারা। ততদিনে হাঁটুতে পচন ধরেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তাররা চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠান। সেখানে অপারেশন করে কোমর পর্যন্ত কেটে ফেলা হয় পা-টি। বের করা হয় দুটি গুলি।
এরপর বাবা ছেলে বাংলাদেশেই থাকছিলেন এক সাথে। এ বছরের জুলাই মাসে বার্মা থেকে খবর আসে জুবায়েরের দাদা মারা গেছেন। অনেক আগে দাদার অসিয়ত ছিল কোরানে হাফেজ জুবায়ের যেন তার জানাযা পড়ায়। দাদার অসিয়ত রাখতেই হবে। অতএব ডান পা ছাড়াই বাবার কাঁধে হয়ে বার্মায় ফিরে সে। দাদাকে দাফন করার দুই সপ্তাহের মধ্য জুবায়েরের নানাকে গুলি করে হত্যা করে মগরা। তারও জানাজা পড়িয়েছে এই কিশোর নাতি। সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের পুলিশ ক্যাম্পে বিদ্রোহীদের হামলার পর আবার বাংলাদেশ ঢুকেছে জুবায়েররা। এবার বাবা, মা, ভাই, বোন ৮ জন। ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রবেশের পর রাতে এক সাথে থাকলেও পরদিন সকালে ত্রাণ সংগ্রহে বের হন বাকিরা। জুবায়ের বসে থাকে একটি দোকানের বারান্দায়। হঠাৎ পুলিশ এসে ওই এলাকার সবাইকে তাড়িয়ে দিলে জুবায়ের তার সাথে থাকা ভাঙা ক্রাচটি ভর করে একদিকে চলে যায়। এরপর থেকে পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পাচ্ছে না সে। বিকাল পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্রাচে ভরে করে চলছিল আর মা বাবাকে খুঁজছিল ভিড়ের মাঝে।
‘তুমি তো বললা তুমি হাফেজ। তেলাওয়াত করে শোনাতে পারবা?’ ‘কোন জায়গাত্তন পড়বো’ পাল্টা প্রশ্ন জুবায়েরের। ‘তোমার যেখান থেকে সুবিধা’। এরপর শুরু হল সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত। ঘরের পেছনে হঠাৎ তেলাওয়াতের সুর শুনে বাড়িতে বের হয়ে এলেন বয়স্ক দুই মহিলা। আমাদের দেখে আবার ভেতরে চলে গেলেন তারা।
বিস্কুট ভাগ করে খাওয়া মা-ছেলে
সুরাইয়া বেগম কক্সবাজারের কুতুপালং এসেছেন মিয়ানমারের টমবাজার এলাকা থেকে। ৫ দিন ধরে পায়ে হাঁটার পর শরীর আর নিজেকেই বইতে পারছে না। তবু কোলে করে ছোট্ট সন্তানটিকে বয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে সুরাইয়াকে। বাংলাদেশে ঢোকার পর থেকে দেড় দিন পার হলেও ভাত পেটে যায়নি দুই ছেলেসহ মায়ের। সকালে কয়েকটি বিস্কুট পেয়েছিলেন। দুই ছেলেকে নিয়ে খেয়েছেন। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে রাস্তায় কেউ খিচুড়ি, কেউ বিস্কুট বিতরণ করছে। কিন্তু শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে ওসব সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। কোলে বাচ্চা নিয়ে ভিড়ের ধাক্কাধাক্কি আর দৌড়াদৌড়ি করার অবস্থায় নেই সুরাইয়া। তাই অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে নিজে বসে আছেন রাস্তার পাশে। ছয় বছরের বড় ছেলে কারো কাছ থেকে কয়েকটি বিস্কুট নিয়ে এসে মায়ের মুখের সামনে ধরলো। ১০ সেপ্টেম্বর সকালে কুতুপালং থেকে তোলা ছবি।
৯ মাসের অন্তসত্ত্বা মাইমুনার দাঁড়িয়ে থাকা
দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাইমুনা খাতুন। বয়স তার ২৭। এই বয়সেই চার সন্তানের মা হয়েছে এই নারী। সবচেয়ে বড় কথা হল পেটে বহন করছেন আরেকটি সন্তান। নয় মাস পার হয়েছে তার গর্ভের। আর কয়েক দিনের মধ্যেই পঞ্চম সন্তানের মুখ দেখবেন মাইমুনা-নূর আলম দম্পতি। কুতুপালংয় এসেছেন মিয়ানমারের বুচিডঙ থানা থেকে। তার পাড়ার নাম উদঙ। মাইমুনার মোটেও শখ ছিল না নয় মাসের অন্তসত্ত্বা অবস্থায় দেশে দেশে হেঁটে বেড়াবেন। আর ভিন দেশে এসে কোনো এক সন্ধ্যায় একটি মহাসড়কের পাশে গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন অবসন্ন শরীর নিয়ে। পাড়ায় বিভিন্ন বাড়িতে মগরা আগুন দিয়েছে। খবর পেয়ে নূর আলম আর মাইমুনা দ্বিতীয় কিছু ভাবার সুযোগ পাননি। চার সন্তানকে বগলে নিয়ে সীমান্তের দিকে ছুটেছেন স্বামী স্ত্রী। ৯ সেপ্টেম্বর তাদের তিন দিন হয়েছে কুতুপালং পৌঁছার। ‘আপনি এই অবস্থায় কষ্ট করে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার জামাই কই?’ মাইমুনা জানালেন, তার জামাই বসে নেই। উনি দৌড়াদৌড়ি করছেন বাঁশ, পলিথিন জোগাড় করে কোনো মতে মাথা গোজার একটা ঠাঁই করতে। বড় ছেলেটাও বাবার সাথে গেছে। আর ছোট তিনটাকে নিয়ে তিনি এখানে দাঁড়িয়ে কেউ সাহায্য দিলে তা গ্রহণ করছেন।
(চলবে…)
Leave a reply