ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চড়ককে ‘চড়কপূজা’ হিসেবে পালন করে কয়েক শতাব্দী ধরে। কিন্তু সব ধর্মের মানুষের কাছে তা হয়ে উঠেছে অপূর্ব এক মিলনমেলা। চৈত্রসংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় চড়কপূজা।
বড়শিতে গাঁথা আবস্থায় চড়ক গাছে ঝুলে প্রায় ২৫ ফুট শূন্যে বাতাসা ছিটাতে ছিটাতে ঘুরলো একে একে ৫ জন সন্ন্যাসী। প্রতি বছরের মত এবারো সোমবার বিকালে চড়ক উৎসবে গাঁ শিউরে ওঠা এই দৃশ্য দেখলো প্রায় ২০-২৫ হাজার মানুষ।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর বকুলতলায় প্রতি বছর এ উৎসব আয়োজনে এই পূজা হয়ে থাকে।
স্থানীয়রা জানায় প্রায় ২’শ বছর ধরে পঞ্জিকা মতে বৈশাখ মাসের ৩ তারিখে ঐতিহ্যবাহী এই পূজা হয়ে আসছে। পূজাকে ঘিরে বাংলা নববর্ষের শুরুতেই ৩ দিনব্যাপী এখানে চলে জমজমাট লোকজ মেলা।
মেলা ও চড়ক পুজার ঐতিহাসিক দিক নিয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। অধিকাংশের মতে জানা যায়, আজকের এই মহেশপুরের (তৎকালীন সুলতানপুর) এক সময়ের শাসন কর্তা ছিলেন সূর্য় মাঝি। চক্রান্ত করে সূর্য় মাঝিকে হত্যার পর ১৭ জন ব্রাহ্মণ সুলতানপুর পরগনার মালিকানা ভাগ করে নেয়। সেই সময়ের মহেশপুরের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ হলেন হরিনারায়ন চৌধুরী। তার সময় জমিদাররা মহেশপুরের প্রভুত উন্নয়ন সাধন করে। চারিদিকে গড়ে উঠে বহু সুরমা প্রাসাদ। তখন বিভিন্ন ধরনের পূজা অনুষ্ঠিত হতো। পূজারীদের আনাগোনায় এ অঞ্চল থাকতো জমজমাট। এরও অনেক আগে মহেশপুরে হিন্দু ধর্মবলম্বীদের বসবাস ছিল। এজন্য ১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মহেশ্বর (শিব) মন্দির স্থাপন করা হয়।
জনশ্রুতি আছে, কপোতাক্ষ ও বেতনা নদীর সংযোগস্থলে ধীরে ধীরে একটি নতুন চর জেগে ওঠে। এই চরে স্বয়ং আবির্ভূত হয় মহেস্বর মন্দির যার অন্য নাম বুড়ো শিব। তার নাম অনুসারেই প্রতিষ্টিত হয় মহেস্বর (শিব) মন্দির। এর কিছুকাল পরে ফতেপুর কপোতাক্ষ নদের পাশে আরও একটি চর জাগে। সেই চরে ফতেপুর এলাকার জমিদার বংশের লোকজন অন্যান্য পূজার সাথে চড়ক পূজা শুরু করে। ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় এ পূজা শুরু করা হয়। মহেশপুর, ফতেপুর ও বর্জাপুর গ্রামে এখনো জমিদার বাড়ির শেষ চিহ্ন কালের সাক্ষি হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো মন্দিরে বিগ্রহ আছে। মহেশপুর পৌর সভার উত্তর পাশে এর অবস্থান। দেশ-বিদেশ থেকে এখানে ভক্তরা এসে থাকে।
আয়োজকরা জানান, চড়ক একটি ব্রত। চৈত্র মাসের শেষ দিন শিবভক্ত বানরাজা তাঁর সঙ্গী-সাথী নিয়ে নাচ-গানে আত্মহারা হয়ে শরীরের রক্ত বের করে ছেলের উদ্দেশে নিবেদন করেন। বানরাজার রক্ত উপহার পেয়ে শিব খুশি হয়েছিলেন। এই কাহিনি অনেক আগের। এর পর থেকে শিব সম্প্রদায়ের ভক্তরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন শিবকে পাওয়ার জন্য চড়ক উৎসবে আত্মহারা হয়। চড়কপূজা ঘিরে আয়োজন করা হয় শিবের গীত, বাজনা ও হরগৌরী নৃত্য।
একটি লাইটপোস্টের মতো কাঠই হচ্ছে চড়কগাছ। এই গাছটি পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির দিন ঢাকঢোল বাজিয়ে শিবের গান গেয়ে পানি থেকে তুলে আনা হয় চড়কগাছ। এবার চড়কগাছ মাটিতে পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি-কাঠ বাঁধা হয়। এরপর সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শি ফুটিয়ে চড়কগাছে ঝুলিয়ে ঘোরানো হয়।
ফতেপুর গ্রামের চড়ক উৎসবের ইতিহাস দুই শ বছরের। অতীতে কলকাতা আদালতের জজ অমূল্যকুমার চট্টোপাধ্যায়, ইঞ্জিনিয়ার নগেন্দ্রনাথ মুখার্জি, ফটিক মুখার্জি, দাশু মুখার্জি চড়ক উৎসবের মূল আয়োজক ছিলেন। বর্তমানে এলাকার অবস্থাসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কমিটি গঠন করে চড়কপূজার আয়োজন করছে।
আগে কপোতাক্ষ নদের পাশে চড়ক ঘোরানো হতো। কিন্তু একজন সন্ন্যাসী পাক ঘোরানোর সময় চড়কগাছ থেকে নদে পড়ে মারা যান। এর পর থেকে ফতেপুরের কাছেই বকুলতলা বাজারে চড়কপূজা ও মেলা বসছে। কারুকার্যময় চৌকি, খাট এই মেলার মূল আকর্ষণ। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে কাঠমিস্ত্রিরা নানা ধরনের আসবাব মেলায় নিয়ে এসেছেন। নাগরদোলা, পুতুলনাচ, নানা ধরনের লটারি, বাঁশি, মাটির পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল মেলার আয়োজনকে করেছে সমৃদ্ধ।
চড়ক পুজা কমিটির সভাপতি স্বাধন কুমার ঘোষ জানান, এ বছর ৫ জন সন্ন্যাসী চড়ক পাকে অংশগ্রহণ করে। এবার যারা সন্ন্যাসী সেজেছে বা পিঠে বড়সি ফুঁটিয়ে রশিতে বেঁধে চড়ক গাছে উঠে ঘুরেছে তারা হলেন, শ্রী অসিত কর্মকার (মনা), অধীর হালদার, মহাদেব হালদার, বসুরেফ বাবু রায় ও বিপ্লব কর্মকার।
তিনি আরও জানান, এ দৃশ্য দেখা এবং কেনাকাটার জন্য এখনো ২০-৩০ হাজার নারী-পুরুষ ও ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে। তবে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর মেলা জমজমাট হয়েছে ।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সিরাজ জানিয়েছেন, এই উৎসব পালনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হয়েছে।
Leave a reply