ভাই গেইছে, ঈদোত নয়া জামা নিয়া আইসপে; নিহত ফায়ার ফাইটার ফরিদের বোন

|

শোকে মূহ্যমান ফায়ার ফাইটার ফরিদের পরিবার ও স্বজনরা।

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর:

আসছে ঈদে নতুন জামার অপেক্ষায় থাকা প্রতিবন্ধী বোন সাবিহা জানেনা ভাই ফরিদুজ্জামান ফরিদ তাকে আর কখনই স্নেহাশীষ দেবে না, জামাও কিনে আনবে না আর। চাচাতো ভাই রানার আকুতিও শুনবে না ফরিদ। জমি কিনে নিজের ভিটেতে উঠে বাড়ি করার যে পরিকল্পনা ছিল তাও আর বাস্তবায়ন হবে না। বাবার ঋণও আর পরিশোধ হবে না। কারণ চট্রগ্রামের সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ফায়ার ফাইটার ফরিদ।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আদারহাট দক্ষিণপাড়ায় সাইফুল ইসলামের পুত্র ফরিদই ছিল ওই সংসারের একমাত্র রোজগেরে। ওই বাড়িতে এখন শুধুই শোকের মাতম। রংপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী জানান, ১৯ মাস আগে সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ফায়ার ফাইটার (সিপাহী) পদে যোগ দেন ফরিদুজ্জামান ফরিদ। শনিবার (৪ জুন)রাতে সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অনেক নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী রয়েছেন। এদেরই একজন ফরিদুজ্জামান। আগুন নিভাতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি, রোববার রাতে লাশ পাওয়া যায় তার। লাশ শনাক্তে ডিএনএ টেস্টের জন্য ফরিদের বাবা সাইফুল ইসলাম ও মা ফুলমতি বেগমকে চট্রগামে নেয়া হয়েছে ইতোমধ্যেই।

পেশায় ভ্যানচালক বাবা অন্যের জমিতে বাড়ি করে বসবাস করলেও চরম দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে পড়ালেখা শেখানোর পর চাকরির সুযোগ হয়েছিল ফরিদের। পরিকল্পনা ছিল জমি কিনে নিজের বাড়ি করার। ঘুচবে দারিদ্রের কষাঘাত। কিন্তু সব কিছুই এখন লণ্ডভণ্ড।

সোমবার (৬ জুন) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ফরিদের টিনে ছাওয়া বাড়িটিতে এখন শুধুই শোকের মাতম। এলাকাবাসীর চোখেও এখন শুধুই পানি। আত্মীয়রা সব আহাজারি করছেন। একমাত্র বোন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সাবিহা এসবের কিছুই বুঝছে না। শুধু সবার দিকে চাইছে।

জানতে চাইলে যমুনা নিউজের প্রতিবেদককে অস্ফুট স্বরে সাবিহা জানায়, ভাই গেইচে। ঈদোত নয়া জামা নিয়া আইসপে।’

ফরিদের এমন মৃত্য কোনোভাবেই মানতে পারছেন না চাচাতো ভাই মাসুদ রানা। রানা জানালেন, ‘আমার ভাইটাক আপানারা নিয়া আসি দ্যান। আমার চাচার বংশ যেনো ভালোভাবে থাইকতে পারে। এ ব্যবস্থা আপনারা করেন। আমার ভাইটা যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় নিয়া আসি দ্যান। বলেই ডুকরে কেঁদে উঠেন রানা।

রানা আরও বলেন, ‘এবার যাওয়ার সময় ভাই আমাক বলি গেইচে, ভাই আসি। সেই ভাইয়ের আমার এই দশা। আপানারা যেভাবেই হোক আমার ছোট ভাইটাতে নিয়ে আসি দ্যান। বড় আশা করি চাইকরিত ঢুকচিল আমার ভাই। ’

চাচী সাথী বেগম চোখের পানি মুছছিলেন মাথায় পেচানো ওড়না দিয়ে। তিনি জানালেন, ফরিদের ছোটবোন একটা আচে প্রতিবন্ধি। হাঁটা চলাফেরার সমেস্যা হয় তার। তার জইন্যে জামা আইনবার চাইচল (চেয়েছিলো) ঈদের সময়। সেই আশাটাও পূরণ হইলো না। আপনাদের কাছে অনুরুদ (অনুরোধ) তার মরা দেহ আইনা দ্যান।

চাচা ছামিউল ইসলামের চোখ দিয়েও পানি ঝরছিল অঝোর ধারায়। তিনি বলেন, হামরা ৫টা ভাই, অশিক্ষিত মানুষ। ভাইজতার ওপর পদক্ষেপ নিচিলাম লেখাপড়ার জইন্যে। হামরা যতকোনা (যতটুকু) পারি লেকাপড়া করাইচি। ভাইজতার চাকরি করার আশা ছিল খুপ। চেষ্টা করি চাকরিটা হলোও। ভাইজতার চাকরির বয়স দুই বছর হওয়ার কিছুদিন বাকি আচে। তাতে ভাইজতা খুইব আগি গেচিলো (উন্নতি করছিলো)। ৩০ জনকার ক্যাপ্টেন হিসাবে ভাইজতা ডিউটি সটিকভাব পালন কইরচে। হামার ভাইজতা খুব দায়িত্বপালন কইরচে। সর্বপ্রথম হামার ভাতিজাকেই আগুনের ওখানে ৫ জনের গ্রুপে পাঠাইছিল অর বস। তাতে হামার ভাইজতায় নিঁখোজ হয়। ভাইজতা ডিউটিত কোনো ফাঁকি দ্যায় নাই।’

অপর চাচা আমানুল্লাহর ভেতর ভেঙ্গে যাচ্ছিল, তবুও তিনি সেটা বুঝতে দিচ্ছিলেন না। সবাইকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। তিনি জানালেন, অত্যন্ত গরীব পরিবার। আমার এই ভাইয়ের ঘরবাড়ি নাই, কিচ্ছু নাই। জমাজমি নাই। তারা মানুষের জমিতে ঘর করি আচে। রিকশা-ভ্যান চালায়ে খায়। ওই ভ্যান চালায়ে ট্যাকা কামাই করে সন্তানকে লেখাপড়া করাইচে। তারপর চাকরিটা সে অতি কষ্টে পাইছিল। আল্লাহ তার ভাইগ্যে রাইখছিল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, যেহেতু সে চাকরিত ছিল, অল্প বয়সে সে দুনিয়া থেকে চলে গেলো। এই পরিবারটা যেন সুষ্ঠভাবে চইলতে পারে, আমি এই দাবি করি। ভাইয়ের এখন এক সন্তান থাকলো, সেও প্রতিবন্ধী। তাদের জইন্য সরকার যেন কিচু করে।

ফুফু হামিদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘হামার ভাইয়েরা মাইনষের জমিত থাকে। হামার ভাইয়ের অনেক ঋণ। ভাইজতা আগুনোত পুড়ি মরি গেলো। এ্যলা হামার ভাই বাঁচে কি না বাঁচে। ভাইজতিও প্রতিবন্ধী। তাই কথাও কইতে পারে না মাইনষের সাথে। তাক নিয়ে আরেক যন্ত্রনা। এখন ভাইজতা কোনাও গেলো। তোমরা হামার এই পরিবারটাক একনা মহব্বত করি দ্যাও বাবারে।

ফরিদের অপর ফুফু আখতারা বেগম জানান, আমার ভাতিজা মারা গেইচে, আমার ভাই অসহায়। হামার ছয়টা ভাই। তাদের কিচ্ছু নাই। হামার মামারা হামার মাক একনা জমিন দিচে। তাও এ্যালাও নেকানেকি করি দ্যায় নাই। খোসাবাড়ির মোতন খোসাবাড়িত হামার ভাইয়েরা আচে। তারপরও হামার ভাই ভ্যান চালায়া ভাতিজাটাক নেকাপড়া করাইচে। কষ্ট করি চাকরিটাও নিয়া দিচে। হামার ভাতিজা তো দুনিয়া থাকি চলি গ্যালো। হাসিনা মাওয়ের কাচে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে) হামরা চাই হামার ভাই-ভাবি আর ভাতিজির দিকি যেন একনা দ্যাকেন’

তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন ফরিদ। তার স্ত্রী তিষার সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। তার মুখে কোনো ভাষাই যেন নেই।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমাতুজ জোহরা জানালেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় তার সকল তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। ইতোমধ্যেই জেলা প্রশাসক স্যারের সাথে কথা হয়েছে। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার লাশ বাড়িতে আনার বন্দোবস্ত করা হবে। তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে ফরিদেরর পরিবারের জন্য যা যা করা দরকার সবই করা হবে।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply