বন্যার কবলে তিস্তা অববাহিকা, দুর্গতদের পাশে নেই কেউ

|

তিস্তায় বেড়েছে পানি, দূর্গত মানুষের সাহায্যার্থে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের।

স্টাফ করেসপডেনট, রংপুর:

গজলডোবার গেট খুলে দেয়ায় উজানের ঢল এবং বর্ষণে শুক্রবারও তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ৫০ হাজারেরও বেশী মানুষ কমবেশি পানিবন্দি, তলিয়ে গেছে বাদামসহ বিভিন্ন উঠতি ফসল। দুর্গত মানুষের পাশে এখনও পৌছেনি কোনো সহায়তা।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলের কারণে ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তায় বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে ১০ সে.মি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। তবে শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল ৯টায় তা ৫ সেন্টিমিটার নীচে নেমে আসে। এখনও ৫ সে.মি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে আবারও বিপদ সীমা অতিক্রম করবে।

পাউবোর এ কর্মকর্তা আরও জানান, এ পূর্বাভাস আমরা দু-এক সপ্তাহ থেকে সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি। যাতে নদী অববাহিতকার লোকজন নিরাপদে অবস্থান নিতে পারেন। গবাদিপশুসহ অন্যান্য জিনিস সরিয়ে নিতে পারেন।

এদিকে, রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ১১৯ দশমিক ৯ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তলিয়ে গেছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষীটারী, সদর, গজঘণ্টা ও মর্নেয়া, কাউনিয়ার বালাপাড়া, পীরগাছার ছাওলা, তাম্বলপুর ইউনিয়নের তিস্তার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের বাদামসহ বিভিন্ন ফসলি জমি। হাজার হাজার বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক বাসা-বাড়িতে এখনও হাঁটু ও কোমর সমান পানি।

লক্ষীটালী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে পানিবন্দি বয়স্ক ও শিশুদের নৌকায় করে উঁচু স্থানে নেয়া হয়েছে। বন্যা এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের তীব্র সঙ্কট বিরাজমান। ভুক্তভোগীদের জন্য এখনও কোনো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেনি কেউই।

এদিকে, বিভিন্ন পয়েন্টে ধরেছে তীব্র ভাঙ্গন। মানুষ অনেক কস্ট করে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। লক্ষীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি গ্রামের পানিবন্দি সামিনা বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, হামরা পানিত মরি যাওসি। আর তোমরা খালি হামাক ভিডিও করি কামাই করোছেন। হামরা যে কয়দিন থাকি পানিত পরি আচি কেউ তো আইসলেন না। কই রান্দি কই বারি, ছোট ছাওয়া পোয়াক ধরি কই যাই। চকির ওপররোত চকি দিয়া কোনোমতে আইত কোনা নিয়া যাই। মেম্বর-চেয়ারম্যানেরা এতি ভুলকি দিয়াও দ্যাখে না।

একই এলাকার বয়োবৃদ্ধা ফাতেমা জানালেন, হামরা ১৫ দিন হলো থাকি পানিত। মেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ আইসে নাই। বাচি আচি না মরি গেছি কেউ পুসও করে নাই। তোরা খালি ফটো তুলি নিয়া যান, হামার গুলার জইন্যে কিছু করেন বা।

ওই গ্রামের পানিবন্দি নাসিমা বেগমের বাড়ি নদী থেকে আর ৫ গজ। যেটুকু বাড়িঘর এখনও অবশিষ্ট আছে সেটুকুই দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তিনি জানালেন, হামার আর কিচুই থাইকলো না। ঘরকোনা সরে নিয়া যাওসি। চেয়ারম্যান বান্দোদ ঘর কোনা তুইলার কইছে। ওট্টই নিয়া যায়া থোমো। রাইত কোনা যে কী হয়!

লক্ষীটারী ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার মনেয়ারুল ইসলাম জানান, আমরা নৌকা দিয়ে বৃদ্ধ এবং শিশুদের উচুতে নিয়ে আসছি। কোন সহযোগিতা করতে পারি না। ওপরে জানিয়েছি। তারা এখন পর্যন্ত আসেওনি।

লক্ষীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি জানান, বিপদসীমার ওপরে যাওয়ায় আমরা মাইকিং করে যারা বৃদ্ধ নারী এবং শিশু আছে, তাদেরকে আমরা রেসকিউ করে নিরাপদ স্থানে আনছি। আমার ইউনিয়নের ৫ টি ওয়ার্ডের ইতোমধ্যেই ১০ হাজার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত পানিবন্দি কোনো মানুষকে আমরা সহযোগিতা করতে পারিনি। তবে ইউএনও মহোদয়কে জানানো হয়েছে। কিন্তু সাহায্য এখনও পাওয়া যায়নি।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের ৬ টি ওয়ার্ডের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবারের সঙ্কট রয়েছে। কিন্ত এখনও পর্যন্ত আমরা তাদেরকে কিছুই দিতে পারি নাই।

নোহালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটুল জানান, ওই ইউনিয়নের ১৬ হাজার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের খাবারের তীব্র সঙ্কট রয়েছে।

মর্নেয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার মানুষ পাবিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তিনিও এখন পর্যন্ত কাউকে কোনো খাদ্য সহায়তা দিতে পারেন নি।

গজঘন্টা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, প্রতিদিনই তার ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। মানুষ পানিবন্দি হচ্ছে। বাদামের সব ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

এদিকে কাউনিয়ার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী জানান, বন্যা আর ভাঙ্গন আমার ইউনিয়নের ২ হাজার পরিবারকে এখন আকড়ে বসে আছে। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা এবং নদীপাড়ের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, তিস্তায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় নিলফামারীর ডিমলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারি, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি, এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। কোথাও কোথাও কোনো কোনো বাড়িতে কোমর অবধি পানি ঢুকেছে। এসব এলাকার উঠতি বাদাম, আমনের চারা, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে পানির তোড়ে ভেঙ্গে গেছে। দুর্গত এলাকায় মানুষ খুবই বিপাকে পড়েছেন। কোথাও কোনো সহযোগিতা পৌছে নি। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের কস্টটা চরমে। গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে গৃহস্থরা।

এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলা ছাড়া আর মহিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আপদকালীন বালুভর্তি জিও ব্যাগ রেখে দিয়েছেন। সম্ভাব্য ভাঙ্গন ঠেকাতে এসব জিও ব্যাগ আগাম মজুদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। এছাড়াও বিনবিনিয়ায় দুটি স্থানীয়দের দেয়া বাঁধ আটকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাশের স্পার ও জিও টিউব ব্যাগ ফেলছে।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply