হোসাইন শাহীদ, ময়মনসিংহ
তিনি ছিলেন ঐশ্বরিক প্রতিভার অধিকারী। বাংলা কাব্য ও সাহিত্য ভাণ্ডারে তিনি এক বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন। মানবতাবাদী চেতনা যার সৃষ্টি কর্মে ভেসে আসে। তিনি একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, বিপ্লবী এবং ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান। চুরুলিয়া গ্রামে এক মাটির ঘরে দুখু মিয়া নামে যে শিশুটি ভূমিষ্ট হয়েছিল এবং দারিদ্র ও কঠিন জীবন সংগ্রামে ঝাপিয়ে পরেছিল তিনি। হ্যাঁ তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই বিদ্রোহী কবির জীবনের সাথে ত্রিশাল নামটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। এই বিদ্রোহী কবিকে তার জীবদ্দশায় কোন বাঁধনে বেধে রাখা যায়নি তবে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় কবির স্মৃতিকে ঠিকই বেঁধে রেখেছেন এ জনপদের মানুষ। কবির স্মৃতি বলয়ে ঘেরা ত্রিশাল এখন নজরুল পল্লী হিসাবে খ্যাত। ঢাকা থেকে মাত্র একশ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার অবস্থান। কবির ১১৯ তম জন্ম বার্ষিকীতে অতিথি, পর্যটক, নজরুল প্রেমিক উৎসাহীরা ছুটে যাচ্ছেন এই নিঃসর্গের কোলে। আপনিও যান্ত্রিক জীবনের বাইরে হারিয়ে যেতে বেড়িয়ে আসতে পারেন নজরুল পল্লী ত্রিশালে।
কাজীর শিমলা দারোগা বাড়ী
কাজী রফিজ উল্লাহ্ দারোগা ১৯১৪ সালে আসানসোলের রুটির দোকান থেকে কিশোর কবি নজরুলকে ত্রিশাল কাজীর শিমলা নিজ গ্রামে নিয়ে আসেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল কাজীর শিমলা মোড় থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার পশ্চিমে দারোগা বাড়ি। এখানে রয়েছে দুই তালা বিশিষ্ঠ নজরুল পাঠাগার ভবন। নজরুলের বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ হচ্ছে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শোষনের বিরুদ্ধে, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে। অত্যাচারিত, শোষিত, শ্রেণী বৈষম্য পিড়ীত মানুষকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কবির অন্যবদ্য সৃষ্টি গুলো এখানে রয়েছে। এছাড়াও তার কবিতা গানের বই আগত দর্শনার্থীদের মানবতাবাদী চেতনার খোরাক যোগাবে।
দরিরামপুর
ত্রিশাল বাসষ্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমী (সাবেক দরিরামপুর হাই স্কুল) এখানে কবি ৭ ও ৮ম শ্রেনিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নজরুল লিখে ছিলেন ‘আমি এক পাড়া গাঁয়ে স্কুল-পালান ছেলে, তার উপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুজেঁ পাওয়া যাবেনা। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই, আজও জল তেষ্টা পেয়ে যায়’। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে কবির সেই ক্লাস রুম ও দেয়ালে এই কবিতার লাইন খোদাই করে সংরক্ষণ করা আছে। স্কুল মাঠের পাশেই ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে নজরুল মঞ্চ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেষ্ট হাউজ।
নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র
দরিরামপুর হাই স্কুলে (বর্তমান নজরুল একাডেমী) যাতায়াতের সুবিধার জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রাম ত্রিশাল নামাপাড়ায় বিচ্যুতিয়া বেপারী বাড়ীতে কবি জায়গীর থাকতেন। এই বিচ্যুতিয়া বেপারীর বাড়ীতেই ১ একর জায়গায় নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্দেগ্যে এক মনোরম পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র। নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রের মূল ভবনে রয়েছে কবি নজরুল সংগ্রহশালা ও পাঠাগার। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত বাণীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙ্গালির স্বাধীন ঐত্যিহাসিক সত্ত্বার রুপকার। বাঙ্গালির ইতিহাসের দুক্ষেত্রের দুই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও কবি নজরুলের মুখোমুুখি কিছু মূহুর্তে এখানে সংগ্রহশালায় দেখা মিলবে। ১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা আ্যালবার্ট হলে বাঙ্গালী জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত মানপত্রের জবাবে নজরুল বলেছিলেন সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি। নজরুলের এসব বলিষ্ট উচ্চারন নিয়ে গবেষণার সহযোগী ক্ষেত্র এখন এই পাঠাগার। এখানে কবি নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি পুণঃ নির্মাণ করা হয়েছে। কবি তার কবিতা গানে যে সকল গাছের নাম উল্লেখ করেছেন সেই গাছগুলো দিয়ে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে ব্যাতিক্রম র্ধমী দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখানে কবি যে পুকুরে গোসল করতেন সেটি সংরক্ষণ করা আছে। কবিতা মানুষের কল্পনা ও আবেগের প্রকাশ আর আবৃত্তি শিল্পিকে বলা যায় কবির ভাষ্যকার। এখানে পুকুরের বাধাই করা ঘাটে হাসনাহেনা ফুল গাছের নিচে চাঁদের আলোয় কবি ভাষ্যকারের কাজ করতে কার না ভালো লাগবে।
বটতলা
স্কুল পালিয়ে ত্রিশাল নামাপারা শুকনি বিলের পাড়ে একটি বট গাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন। এটি এখন নজরুল বট বৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুল ভক্তদের কাছে এটি তীর্থস্থান। বটের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই কিন্তু এই বট গাছটি আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করবে। নজরুল জন্ম জয়ন্তীতে বট বৃক্ষের ছায়ায় বসবে নজরুল প্রেমীদের মিলন মেলা।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল উপজেলায় নামা পাড়া গ্রামের শুকনি বিলের পারে নজরুল বট বৃক্ষের পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম ও একমাত্র সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। নিঃস্বর্গের কোলে ২০ একর জমিতে ২০০৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বিদ্রোহী কবির স্মৃতি বিজরিত ত্রিশাল হয়ে উঠেছে নজরুল চর্চার এক পীঠস্থান। কবি তার কালের তরুণদের যেমন প্রেরণা ছিলেন তেমনি পরবর্তী প্রজন্মে এবং তারও পরবর্তী প্রজন্মের বলা যায় চিরকালের বাঙ্গালি তরুণদের তিনি প্রেরণার উৎস। নতুন প্রজন্মের কাছে কবিকে তুলে ধরতে জাতীয় কবিকে ঘিরে এ বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম সহ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সফল পদচারনা করছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের কল্যাণে প্রতিদিনই রীতিমত উৎসবের আমেজ তৈরি করছে। আর চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নামের কাবির অঙ্গকে সাজিয়েছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। এর ফলেই কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখর। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে বনভোজনে আসছেন প্রকৃতি প্রেমীরা।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নজরুলকে তুলে ধরতে ত্রিশালকে এক সাংস্কৃতিক বলয়ে তৈরি করা হয়েছে। নজরুল পল্লী ত্রিশালে আসলে তার জীবন সাহিত্য-সঙ্গীত ও সামগ্রীক অবদানের এক ঝলক অনুভব করা যাবে। এছাড়া প্রতিবারের ন্যায় এবারো ২৫ মে কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তিন দিন ব্যাপী নজরুল মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। দুই বাংলার নজরুল শিল্পি ও আলোচককরা এতে অংশ নিবেন।
Leave a reply