সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল এবং রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রোববার (২৪ জুলাই) সকালে নির্বাচন কমিশন ভবনে ইসির সঙ্গে সংলাপে বসে দলটি। এ সময় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, না ভোট চালু এবং ইভিএম-এ ভোট না নেয়ার দাবিও জানায় তারা।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়ত (চেয়ারম্যান) মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজীর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। তাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। ইসির কাছে মোট ৪০টি প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। সেগুলো হলো-
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ:
১. নির্বাচন কমিশনকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সকল দল ও প্রার্থীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সকল ভােটার যাতে নির্বিঘ্নে ভােট কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দমত প্রার্থীকে ভােট দিতে পারেন নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রদত্ত ভােট গণনা ও ফলাফল ঘােষণায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. নির্বাচন কমিশনকে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কাজে সরকার কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
৩. নির্বাচনের তফসিল ঘােষণার পর থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘােষণা ও নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহ বিশেষত: মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে যারা নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন তাদেরকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখতে হবে। প্রয়ােজনে বদলি করা, বরখাস্ত করা ইত্যাদি এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকতে হবে।
৪. নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের সময় অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করে মােতায়েন করতে হবে।
৫. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল বৃদ্ধি করে প্রত্যেকটি নির্বাচনী আসনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের থেকে দক্ষ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়ােগ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যে আইনি ক্ষমতা রয়েছে, নতজানু না হয়ে তা কার্যকর ক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ:
৭. সংসদীয় আসন সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যা অনুপাতে ভৌগোলিক দূরত্ব ও যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, যাতে প্রার্থী ও ভােটারদের ভােগান্তি ও হয়রানির শিকার না হতে হয়।
সংরক্ষিত মহিলা আসন বিলুপ্ত করা:
৮. যেহেতু নারীদের সরাসরি সব আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযােগ আছে অতএব সিলেকশনের মাধ্যমে নারীদের জন্য সংসদে পৃথক আসন সংরক্ষণ করার যৌক্তিকতা নেই। আসন সংরক্ষণের এই ব্যবস্থাটি বৈষম্যমূলক বিধায় তা বিলুপ্ত করা হােক।
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা:
৯. ইভিএমের ব্যাপারে জনগণের স্বচ্ছ ধারণা নেই। ইতােমধ্যেই দেশ-বিদেশে এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আর ইভিএম সম্বন্ধে আমাদের দেশের মানুষ বিশেষত: গ্রাম-বাংলার মানুষ অজ্ঞ। তাই এটি ব্যবহার করা হলে অনেকের ভােট দেয়াও অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অতএব জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।
মনােনয়নপত্র দাখিলের বিধান সহজ করা:
১০. নির্বিঘ্নে ও সহজে যাতে প্রার্থীরা মনােনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনলাইনেও মনােনয়নপত্র দাখিলের বিধান ও ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১১. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর জামানত ১০,০০০/= (দশ হাজার) টাকার মধ্যে রাখতে হবে। ভােটার তালিকা সম্বলিত সিডি প্রার্থীকে বিনামূল্যে প্রদান করতে হবে।
সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠান:
১২. চলমান সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কারণ সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তা প্রভাবমুক্ত হবে না। সে নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযােগ্যতাও পাবে না।
বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত আসনে ফের নির্বাচনের বিধান করা:
১৩. বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর গেজেট প্রকাশ না করে ফের নির্বাচনের বিধান করতে হবে। তখন জীবননাশের হুমকি দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার প্রবণতা বন্ধ হবে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথও বন্ধ হবে।
অপরাধীদের নির্বাচনে অযােগ্য ঘােষণা করা:
১৪. ঋণখেলাপীদের মতাে ইসলামবিদ্বেষী, ধর্মদ্রোহী নাস্তিক, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, খুনি, সন্ত্রাসী, কালােটাকার মালিক, অবৈধ সম্পদকে বৈধকারী ও ঋণখেলাপীদের সাথে জড়িত পরিবারবর্গকে নির্বাচনে অযােগ্য ঘােষণা করতে হবে।
১৫. দল থেকে বহিষ্কার হলে যেমনিভাবে সংসদীয় পদ বাতিল হয়ে যায়, তেমনিভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গ, দলীয় মেনিফেস্টোর লঙ্ঘন, স্বৈরাচারনীতি, খুনি-সন্ত্রাসী ও ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেলে কমিশন কর্তৃক তার সদস্যপদ বাতিল করার বিধানও করতে হবে।
নিবন্ধন শর্তাবলী শিথিল করা:
১৬. অবাধ ও মুক্ত রাজনীতি চর্চার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তাবলী শিথিল করতে হবে।
১৭. রাজনৈতিক দলের সকল কমিটিতে ৩৩% নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করতে হবে।
১৮. কোরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক কোনো শর্ত আরােপ করা যাবে না।
১৯. নির্বাচনে ব্যয়ের বৈধ সীমা ক্রমাগত বেড়ে চলায় সৎ, যােগ্য ও আদর্শবান সাধারণ নাগরিকগণ সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২৫ লাখ টাকা ব্যয় বৈধ হলেও তার সাথে আরও ২০/৩০ কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করে অনেক প্রার্থী বিজয়ী হয়। পরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লুটে নেয়। অতএব দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং যােগ্য ও আদর্শবান লােকদের নির্বাচিত করতে নির্বাচনী ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে।
২০. নির্বাচনী ব্যয় কমানাের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একই আসনে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নাম ও প্রতীক সংবলিত একই পােস্টার ছাপানাে এবং তা প্রার্থীদের কাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
২১. ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম প্রমাণিত হলে প্রার্থিতা বাতিল এমনকি নির্বাচিত হলেও তার সদস্যপদ বাতিলের আইন করতে হবে।
২২. না ভােটের বিধান পূণরায় চালু করতে হবে।
নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষা করা:
২৩. নির্বাচনকে অর্থ ও পেশীশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। সবার জন্য সমান সুযােগ তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
২৪. নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলাের নির্বাচনী ইশতেহার ও ভাষণ বেতার/টেলিভিশনে প্রচারের সুযােগ দিতে হবে। এছাড়া নিরপেক্ষ প্রচারে মিডিয়ার ওপর কোনোরুপ বাধা সৃষ্টি যাতে না করা হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২৫. নির্বাচনে ভােট ক্রয়-বিক্রয় এবং কালােটাকা ও পেশীশক্তির ব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়ােজনীয় নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে।
২৬. প্রার্থী ও ভােটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যেকোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে।
২৭. সকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও নির্বাচনের পূর্বে লাইসেন্সকৃত সকল অস্ত্র জমা নিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রস্তাবনা:
২৮. ভােট দানে পেশীশক্তির প্রয়ােগ ও সরকারি সুযােগ-সুবিধা কাজে লাগানাে সম্পূর্ণরুপে বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২৯. সবাই যাতে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলে সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৩০. ভােটের আগের দিন থেকেই ভােটকেন্দ্র, ভােটের সরঞ্জাম ও ভােট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি কেন্দ্রে সেনাবাহিনীসহ পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মােতায়েন করতে হবে।
৩১. নির্বাচনী কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কোনো দলীয় লােকের মেহমানদারি গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করতে হবে।
৩২. ভােটকেন্দ্র ও এর আশেপাশে দলীয় ক্যাডারদের মহড়া/যৌথ মহড়া বন্ধ করার আইন করতে হবে।
৩৩. দেশি-বিদেশি নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কোনোরুপ বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।
৩৪. ভােট প্রদানের গােপন স্থান ব্যতিত প্রতিটি ভােটকেন্দ্রের প্রবেশ পথের বাহির ও ভিতরের সকল স্থানকে সিসিটিভির আওতায় এনে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ভােট গণনার পর সিসিটিভির সিডি রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দিতে হবে।
৩৫. ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভােট জালিয়াতি, জাল ভােট প্রদানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩৬. ভয়ভীতি প্রদান করে বা জোরপূর্বক প্রার্থীর এজেন্ট, ভােট গ্রহণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ভােটারদের ভােটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩৭. প্রবাসীদের জন্য ভােটাধিকার প্রয়ােগের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
৩৮. ভােট গ্রহণ সমাপ্ত হলে উপস্থিত সকল প্রার্থীর প্রতিনিধিদের সামনে ভােট গণনা করে প্রতি কেন্দ্রে ফলাফল ঘােষণা নিশ্চিত করতে হবে। ঘােষিত ফলাফলের কপি উপস্থিত সকল প্রার্থীর এজেন্টকে সরবরাহ করতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা:
৩৯. অতীত অভিজ্ঞতার আলােকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযােগ্য নির্বাচন হয় না। নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতাে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন অপরিহার্য। এ পদ্ধতি বাতিল হওয়ায় দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অস্থিরতা ও অবিশ্বাস বেড়েছে। উক্ত বিষয়টিও বিবেচনায় রাখবেন।
৪০. দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনগণের ভােটাধিকার প্রয়ােগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ইউএইচ/
Leave a reply