এর আগে একসাথে এতো দুর্ঘটনার রোগী দেখেনি রংপুর মেডিকেল

|

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

নীলফামারীর সৈয়দপুরের অপু-ক্লাসিক কাউন্টারের ম্যানেজার স্বামী শামীমের সাথে স্ত্রী সোহাগীর শেষ কথা হয় রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ১১ টায়। তখন সৈয়দপুর থেকে মডার্ন মোড় পর্যন্ত গাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে এখন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাই মধ্যরাতে অবুঝ সন্তানকে কোলে নিয়ে সোহাগী ছুটে এসেছেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

রোববার দিবাগত রাত পৌনে ১টায় রংপুরের তারাগঞ্জের খারুভাজ এলাকায় ঢাকাগামী ইসলাম পরিবহনের সাথে সৈয়দপুরগামী জোয়ানা পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় আহত হয়ে সোহাগীর স্বামী হাসপাতালটির ১৯ নং নিউরোসার্জারি বিভাগের বারান্দায় মুমূর্ষ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। রাত সাড়ে ৩টায় তার সাথে কথা হলে তিনি উৎকণ্ঠার কথা জানান।

ওই ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একসাথে এতো দুর্ঘটনায় আহত রোগীর চিকিৎসা দিতে হাঁপিয়ে উঠেছে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। অপরিচিত হওয়ায় রোগীদের রক্ত এবং ওষুধের সংকটও তৈরি হয়েছে হাসপাতালটিতে।

রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আজ সকাল সাড়ে ৯ টায় দুর্ঘটনা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি জানান, ঘটনাস্থলেই ৫ জন মারা গেছেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরও ৪ জন। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুটি গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে সড়ক আইনে মামলা করা হয়েছে।

তারাগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ মাহবুব মোরশেদ জানান, ঘটনার সাথে সাথেই স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে, এবং আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করায়। ঘটনাস্থলে মারা যাওয়াদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এসব লাশ তাদের পরিবারের কছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হলেন রংপুরের তারাগঞ্জের হারিয়ারকুঠি ঝাকুয়াপাড়ার মৃত মজিবর রহমানের পুত্র আনোয়ার হোসেন (৩৫), একই উপজেলার সয়ার কাজিপাড়ার মৃত কছিম উদ্দিনের পুত্র আনিছুর রহমান (৪৮) এবং নীলফামারীর সৈয়দপুরের কুন্দল পূর্বপাড়া এলাকার মকবুল হোসেনের পুত্র মহসিন হোসেন সাগর (৪২)। এছাড়াও হাসাপাতালে মৃত চারজনের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের কামারপুকুর এলাকার রায়হানের পুত্র জুয়েল (২৫), একই উপজেলার পানাপুকুর এলাকার নুর ইসলামের পুত্র আরিফ বিল্লাহ (৩০) এবং রংপুরের তারাগঞ্জের পলাশবাড়ীর মৃত বিনোদের পুত্র ধনঞ্জয়। অপরজনের পরিচয় এখনও মেলেনি।

দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে হাইওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, ঘটনার সময় বৃষ্টি পড়ছিল। মহাসড়ক ভেজা ছিল। আমরা মনে করছি যেকোনো একটি বাসের ব্রেক ফেইল হয়েছে। সে কারণে দুর্ঘটনা হতে পারে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।

এদিকে তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেল মিয়া জানান, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে স্ব স্ব উপজেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার টাকা করে দাফন কাফনের জন্য দেয়া হয়েছে। এছাড়াও হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন প্রত্যেকের পরিবারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। হাসাপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম বিভাগীয় কমিশনার এবং ডিসি স্যার মনিটরিং করছেন। কাউকে যদি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে হয়, সেই ব্যবস্থাও তারা করবেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি ইমার্জেন্সি বিভাগের কর্মচারী মিল্টন জানান, ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করে দুটি বাসে করে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন হাসপাতালে নিয়ে আসে। এর আগে কখনও একসাথে হাসপাতালে এত সড়ক দুর্ঘটনার রোগী আসেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ভর্তিকৃত রোগিদেও মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের লোকজন বেশি। এছাড়া নীলফামারী ও রংপুরের লোকও রয়েছেন।

১৫ নং সার্জারি বিভাগের কর্মচারী ইমন মিয়া জানান, আমাদেরকে ফায়ার সার্ভিস খবর দেয়া মাত্রই আমরা প্রত্যেকটি ওয়ার্ড থেকে ৪০টির মতো ট্রলি নিচে নেমে আসি এবং দ্রুত গতিতে তাদেরকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করি। চিকিৎসক, নার্স, ইন্টার্ন চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই মিলে আমরা সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। ওষুধের সংকট ছিল। হাসপাতালে তেমন ওষুধের সাপ্লাই ছিল না। অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের পকেটে যা ছিল তা দিয়ে ওষুধ কিনেছেন। এই সেবাকর্মী জানান, ওয়ার্ড এবং বেডগুলো রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। সেলাই ও অপারেশন করা হয় তড়িৎ গতিতে। ভোর রাত পর্যন্ত ডাক্তার ও নার্সরা সার্জারির কাজ করেছেন।

হাসপাতালে রোববার ভোররাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে দেখা গেছে, হাসপাতালের ১৫, ১৯ এবং ৩১ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে রোগীদের। অপরিচিত হওয়ায় রক্ত এবং ওষুধ সরবরাহে সংকট দেখা দেয়। সন্ধানীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন রক্ত এবং ওষুধ সরবরাহের। গভীর রাতেই হাসপাতলে ছুটে এসে সহযোগিতা করছে জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জানান, আমরা খবর পেয়ে ছুটে এসেছি। রক্ত এবং ওষুধসহ চিকিৎসকদের সাথে থেকে নেতাকর্মীরা রোগীদেও সেবা দেবো। এসব মানুষ সবাই প্রায় অসহায়। তাদের পাশে দাড়ানোর আ্বান জানান এই ছাত্রনেতা।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখা সন্ধানীর ড্রাগ সেক্রেটারি ওয়াহিদুজ্জামান রকি বলেন, আমরা সারারাত ধরে রক্ত ও ওষুধ সহায়তা দিয়েছি। শোনামাত্রই আমাদের কর্মীরা ছুটে এসেছেন। তারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ছুটে গিয়ে এই সেবা দিয়েছেন। দুর্ঘটনার এত রোগি একসাথে আগে আমরা কেউই দেখিনি। এই স্বেচ্ছাসেবী জানান, আত্মীয় স্বজন না থাকায় এবং অপরিচিত হওয়ায় সবার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। তারপর আমাদের স্টক থেকে আমরা রক্ত দিয়েছি, ওষুধ সরবরাহ করেছি। এখানে অনেক রোগীরই দীর্ঘকালীন ওষুধ খেতে হবে। তাদের জন্য ওষুধের সাপোর্ট খুবই প্রয়োজন।

জোয়ানা পরিবহনের এক যাত্রী বলেন, আমি গাড়ির একেবারে পিছনে ছিলাম। যখন শলেয়াশাহ খাল পার হয়ে নতুন ব্রিজে উঠলাম। তখন হঠাৎ করে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি তখন একটু সুস্থ ছিলাম। তখন নিজের জ্ঞান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে বের হই। হয়ে দেখি সামনের গাড়ির চিল্লাচিল্লি। এরপর পর আর কিছু বলতে পারি না।

আহত নাহিনা ফেরদৌসি এবং তুষার মিয়া জানিয়েছেন, দুটি গাড়িতেই যাত্রী ভর্তি ছিল। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ লাগে। তারপর আর কী হলো কেউই বলতে পারেনি।

হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মিনহাজুল আলম শাওন জানান, ওই রাতের মধ্যে এতো আহত রোগীদের ভর্তি করানো এবং রক্ত ও ওষুধ ম্যানেজ করা খুব টাফ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা খুব টেকনিক্যালি সব ম্যানেজ করেছি। এতোগুলো মানুষ একসাথে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আগে কখনই এখানে ভর্তি হয়নি। এই চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে ৪৭ জন রোগীকে আমরা ভর্তি করেছি, এর মধ্যে অর্থপেডিক্স বিভাগে ১১ জন। সেখান থেকে ১ জন মারা গেছেন। আরও ১০/১৫ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরও ৩ জন।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply