স্টাফ করেসপনডেন্ট, কুড়িগ্রাম:
উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাতদরগাহ নেছারিয়া কামিল মাদরাসা শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। এছাড়া গভর্নিং বডি গঠন, নিয়োগসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অনিয়মের ফলে প্রতিষ্ঠানটির আগের সুনাম এখন আর নেই। এতে গুণগত পড়ালেখার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন।
হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের সাতদরগাহ নেছারিয়া কামিল মাদরাসা। অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ শতাধিক দাবি করলেও কাগজে কলমে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩১ জন। করোনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলে মাদরাসা থেকে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয় তাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখানো হয়ে ২০৪ জন। সরেজমিনে দেখা যায়, মোট ৫৮ জন উপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪র্থ শ্রেণিতে ৪ জন, ৫ম শ্রেণিতে ৩ জন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ১৩ জন, ৭ম শ্রেণিতে ২৩ জন, ৮ম শ্রেণিতে ১১ জন, ৯ম শ্রেণিতে ১০জন, ১০ম শ্রেণিতে ৪ জন এবং আলিমে ১জন। এবতেদায়ী, ফাজিল ও কামিল শাখা শিক্ষার্থী শূন্য। অবশ্য পাঠদানের জন্য মাদরাসায় শিক্ষক রয়েছেন ৫৩ জন। প্রতি মাসে শিক্ষক-কর্মচারীসহ বেতন দেয়া হয় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা।
সাতদরগাহ গ্রামের মৃত বাসিন্দা আব্দুন্নাছির পীর সাহেব কেবলাসহ স্থানীয় কয়েকজন ইসলামি শিক্ষানুরাগী ১৯৪২ সালে কয়েক একর জমির ওপর এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা মতিয়ার রহমান অধ্যক্ষ থাকা পর্যন্ত ভালোই চলছিল মাদ্রাসাটি। কিন্তু তিনি অবসরে যাওয়ার পর অধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে শুরু হয় নানা জটিলতা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১২ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান মাওলানা আবুল কাশেম। এ নিয়ে শুরু হয় শিক্ষক ও কমিটির মধ্যে দলাদলি ও মামলা-মোকদ্দমা। বর্তমানে এই ইসলামি প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থী সংকটে পড়ে অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। প্রতিষ্ঠানের এমন দুরাবস্থার জন্য অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করছেন অভিভাবক মহল।
এরই মধ্যে অনেকেই শিক্ষকতা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। আলিম শাখায় উপস্থিত একমাত্র শিক্ষার্থী নাজমুল হুদা বলেন, আগে ৫ জন ছিল এখন তারাও আসে না। যদিও আলিম শাখায় কাগজে কলমে শিক্ষার্থী আছে ৩৩ জন।
কয়েকজন মেয়ে শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের মাদ্রাসায় শিক্ষকের সংকট নেই। তবে সংকট শিক্ষার্থীর। এমনকি মাদরাসার টয়লেটগুলোরও দুরবস্থা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক বলেন, আলিম থেকে ওপরের দিকে যত শিক্ষার্থী ভর্তি দেখানো হয়েছে তার অধিকাংশই ভুয়া। তাদের মূল কাগজ পত্র নেই। অধ্যক্ষের পকেট কমিটি, নিয়োগ বাণিজ্য, মাদরাসার জমি-পুকুর লিজের টাকা আত্নসাৎ এবং শিক্ষকদের সাথে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কয়েকজন শিক্ষক চাকুরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেছেন বলেও জানালেন তারা।
প্রতিষ্ঠাতার ছেলে মুহেব্বলুল হাসান করিম বলেন, ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর সংশোধিত ও প্রতিস্থাপিত গেজেটে বলা হয়েছে, ‘কোনো শিক্ষক কিংবা শিক্ষক শ্রেণির সদস্য গভার্নিং বডির সভাপতি পদে মনোনীত হইবেন না।’ অথচ অধ্যক্ষ নিজের স্বার্থের জন্য শিক্ষক শফিকুর রহমানকে সভাপতি এবং আপন ছোটভাই আব্দুস সালামকে সহসভাপতি করে বিধি বহির্ভূতভাবে একটি পকেট কমিটি করেছেন ও দাতা সদস্য জীবিত থাকার পরেও পদটি শূন্য দেখানো হয়েছে। আমরা চাই অধ্যক্ষের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ অনিয়ম বন্ধ করে ঐতিহ্যবাহী এই মাদরাসার সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
তিনি আরও বলেন, অধ্যক্ষ নিয়োগ, কমিটি গঠন ও নানা অনিয়ম নিয়ে প্রায় ১২/১৩টি মামলা হয়েছিল। সবগুলো নিষ্পত্তি হলেও এখনও কমিটির বিরুদ্ধে করা মামলাটি চলমান আছে।
মাদরাসার সভাপতি এবং উলিপুর আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আমি সভাপতি হয়েছি। আমি অসুস্থতার জন্য ঢাকায় আছি। পরে সামনাসামনি কথা হবে।
তবে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কাশেম মনে করেন, মাদরাসায় পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী আছে। তারা নিয়মিত উপস্থিত না থাকায় অনুপস্থিতির হার বেশি। আর গভর্নিং বডি গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটিও বিধি অনুযায়ী করা হয়েছে।
উপজেলা মাধ্যমকি শিক্ষা কর্মকর্তা শাহ্ মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক কর্মরত অবস্থায় গভর্নিং বডি গঠনে কোনো পদে থাকতে পারবেন কিনা এই বিষয়টি বিধিতে অস্পষ্ট। কেননা সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়নি স্ব-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাকি অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পদে থাকতে পারবে কিনা। এছাড়াও মাধ্যমিক ও মাদরাসা বোর্ডের গভর্নিং বডি গঠন নিয়েও কনট্রাডিকশন আছে।
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রংপুর বিভাগ রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সেকশন অফিসার আনিছুল কিবরিয়া বলেন, চাকুরিরত অবস্থায় কোনো শিক্ষকের অন্য মাদরাসার গভর্নিং বডির পদে থাকতে কোন বাধা নেই।
/এডব্লিউ
Leave a reply