অবসাদে ভুগছে ৭৬% বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

|

ছবি: সংগৃহীত

করোনা পরবর্তী পড়াশোনার চাপ, হতাশা ও সেশনজট শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। শিক্ষা কার্যক্রমের চাপে অবসাদে ভুগছে প্রায় ৭৬ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতাও।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ৪০৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে করোনার সময় ২০২০ সালের মার্চ থেকে ১৫ মাসে আত্মহত্যা করেছিল ১৫১ জন শিক্ষার্থী।

শনিবার (৮ অক্টোবর) এক সমীক্ষা চালিয়ে এমন তথ্য জানিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন।

দেশের বিভিন্ন পাবলিক, বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তারা দেখতে পেয়েছে, ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিল।

জরিপে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থী ছিল যথাক্রমে ৪৪ ও ৫৬ শতাংশ। প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া কোভিড মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।

এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক চাপেও পড়াশোনায় অনীহা তৈরি, অভিভাবকদের চাপ, কোভিডে মনস্তাত্বিক পরিবর্তনকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জরিপে মানসিক সুস্থতা বিষয়কবেশ কয়েকটি নিয়ামক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে আসে ‘উদ্বেগজনক’ কিছু তথ্য। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৭.৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে কোভিড মহামারী পরবর্তী সময়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগে তারা জর্জরিত।

দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তনও এসেছে শিক্ষার্থীদের জীবনে।  যেমন, মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তিসহ নানা বিষয় তাদের শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে বলে জানায় ৮০.৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। 

দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অংশ হয়ে যাওয়া ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মধ্যে মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের ওপর অতিরিক্ত আসক্তি ও নির্ভরতা শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে ৭০.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।

আবার মানসিক সমস্যাজনিত কারণে প্রতিদিনের ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। যেমন  অতিরিক্ত ঘুম অথবা নিদ্রাহীনতায় ৭১.৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী ভুগছে। যা লেখাপড়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

অভিভাবকদের অতিরিক্ত স্বপ্ন বা প্রত্যাশার চাপে ৫৫.৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী হাঁসফাস করছে জানায় আঁচল। অনেক শিক্ষার্থীই মনে করছেন পরিবার থেকে তৈরি হওয়া ‘অযাচিত’ চাপে তারা পিষ্ঠ।  

কোভিড মহামারী পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এটি ৭৭.০১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে বলে উঠে এসেছে এবারের সমীক্ষায়। একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যবর্তী সময় কম থাকায় ৬৭.১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ বিরতির পর লেখাপড়ার ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আসায় ৭৩.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে।

৭৬.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, চাকরির ক্ষেত্রে ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তার কারণে মানসিক চাপে আছে। এর মধ্যে ৭২২ জন মেয়ে ও ৫৩৫ জন ছেলে রয়েছে। এতে দেখা যায় যে, তুলনামূলকভাবে মেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি চিন্তিত।

আঁচল ফাউন্ডেশনের এবারের জরিপে দেখা গিয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৬৩.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেয়াদে সেশনজটের শিকার হয়ে আটকে পড়েছে। এদের মাঝে ৪২.৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা নূন্যতম এক বছর সেশনজটের শিকার হয়েছেন।

আবার দুই বছর সেশনজটের শিকার হয়েছে ১৩.১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ছয় মাস ও অন্যান্য মেয়াদে ১০ শতাংশ  শিক্ষার্থী এর ভুক্তভোগী।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ এবং বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি ড. মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, করোনার সময়ে ও করোনা পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেক গবেষণায় ও খবরে উঠে এসেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা  থেকে শুরু করে মানসিক শান্তির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষার চাপ, সামাজিকতা, ব্যক্তিগত হতাশার মত বিষয়। এইসব নানা ব্যাপার শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং এর প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে, অনেকক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে।

/এনএএস


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply