রাশিয়া বিশ্বকাপে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। ২০০২ সালের পর এই প্রথম গ্রুপ পর্ব বিদায় নেয়ার শঙ্কায় আলবিসেলেস্তেরা। অবশ্য, স্বপ্নভঙের বেদনা যেন নিত্যসঙ্গী আর্জেন্টিনা সমর্থকদের। সেই ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের ট্রফি উচিয়ে ধরেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তারপর ৩২টি বসন্ত কেটে গেলো, আর্জেন্টিনার আর সোনার হরিণ শিকার করা হলো না।
অথচ, বিশ্বকাপের পরের আসরেই (১৯৯০) আবার সেই সুযোগ এসেছিল। যদিও সেবার প্রথম ম্যাচেই নবাগত ক্যামেরুনের কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় আলবিসেলেস্তেরা। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিষ্ক্রিয় করার ক্যামেরুনীয় প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে ২-০ গোলের জয় তুলে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিলেও পরের ম্যাচে আবার রোমানিয়ার সাথে ড্র করে তারা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে দ্বিতীয় পর্বে ওঠা আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় দারুণ ছন্দে থাকা ব্রাজিলকে। মূল গোলকিপারের ইনজুরির কারণে সুযোগ পাওয়া অখ্যাত গোলকিপার সার্জিও গয়কোচিয়াই আর্জেন্টিনাকে টেনে তোলেন। গয়কোচিয়া যেন চীনের প্রাচীর! বল জালে ঢুকবে কোনদিক দিয়ে। ফলাফল হিসেবে বিদায় নিতে হয় ব্রাজিলকে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে যুগোস্লাভিয়া ও ইতালির সাথে ড্র করেও গয়কোচিয়ার হাতে ভর করে ফাইনালে ওঠে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। কিন্তু, ফাইনালে সেখানে ইতালির কাছে ১-০ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। টানা দ্বিতীয় শিরোপার স্বাদ পূরণ হয়নি ভক্তকুলের। কিন্তু এই শিরোপা যে এতদিনেও আরাধ্য থেকে যাবে তা কে জানতো?
ডোপ টেস্টে পজেটিভ হয়ে ম্যারাডোনা নিষিদ্ধ! এই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি আর্জেন্টিনা-সমর্থকরা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে রোমানিয়ার বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরে ‘রাউন্ড অব সিক্সটিন’ থেকেই বাদ পড়ে যান বাতিস্তুতারা। ১৯৯৮-র ফ্রান্স বিশ্বকাপে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার সাথে যুক্ত হন ওরিয়েল ওর্তেগাদের মতো এক ঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড়। আর্জেন্টিনা দল নিয়ে আগ্রহও ছিল তুঙ্গে। দারুণ সূচনা করেও কোয়ার্টার ফাইনালে থামতে হয় আলবিসেলেস্তেতের। ম্যাচের ১২ মিনিটে হল্যান্ড এগিয়ে গেলেও ১৭-তম মিনিটে সেটি শোধ করেন ক্লদিও লোপেজ। ৭৮ মিনিটে আর্থার নুম্যান লাল কার্ড পেলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় হল্যান্ড। তবুও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। উল্টো ম্যাচের ৮৮ মিনিটে মাথা গরম ওর্তেগা হল্যান্ডের গোল কিপারকে মাথা দিয়ে বাড়ি মেরে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। ম্যাচ গোল্ডেন গোলে (তখনকার নিয়ম অনুযায়ী) গড়াবে এটাই অবধারিত মনে হচ্ছিল। ৯০-তম মিনিটে ডেনিস ব্যার্গক্যাম্প আচমকা গোল করে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের হৃদয় ভেঙে দেন। প্রতিভাবান দলটি এভাবে বিদায় নেবে তা সমর্থকরা ভাবতেই পারেনি।
কে জানতো, আরও বড় বেদনা ওৎ পেতে ছিল আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জন্য? ২০০২ সালের কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপের কথা বলছি যেটি ছিল আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বাতিস্তুতার গোলে জয় পেলেও, বেকহামের পেনাল্টি কিকে পরের ম্যাচে হার মানে তারা। শেষ ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে ম্যাচ ‘ড্র’ হওয়ায় সমর্থকদের কাঁদিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে।
ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াবে আলবিসেলেস্তেরা এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। সে আভাসই দিচ্ছিল তারা। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত দারুণভাবে এগিয়েছিল তারা। সেখানে স্বাগতিকদের বিপক্ষেও দারুণ খেলছিল রিকুয়েলমেদের আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৪৯ মিনিটে রাবার্তো আয়ালার গোলে এগিয়ে যায় তারা। মাইকেল বালাকের জার্মানি বিদায় যখন নিশ্চিতই মনে হচ্ছিল তখন কোচ দলের মধ্যমাঠের মূল স্তম্ভ রিকুয়েলমেকে তুলে জুলিও ক্রুজকে মাঠে নামান। খানিক পরই ম্যাচের ৮০-তম মিনিটে গোল পরিশোধ করে দেয় জার্মানি। আচমকা চাপে পড়ে যায় নীল-সাদারা। অতিরিক্ত সময়েও গোল না হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে সপ্রতিভ জার্মান গোলরক্ষক ল্যামান দুর্দন্ত সেভ করে আর্জেন্টিনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
২০১০ সালেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানি বাধা। জার্মানির সাথে ম্যাচ মানে স্মৃতি হাতড়ে বেদনা খোঁজা। আর, কে হায় হৃদয় খুঁজে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? আর্জেন্টিনা সমর্থক যেন বেদনাকেই বাসিছেন ভালো। খেলার শুরুতেই জার্মানির থমাস মুলারের গোলে ধাক্কা খায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার অধীনে বিশ্বকাপে দারুণ ছন্দে থাকা আর্জেন্টিনা। এরপর, মরিয়া আক্রমণ করেও গোলের দেখা পায়নি তারা। সে দলে ছিলেন আজকের লিওনেল মেসিও। মাঝমাঠ দখলে রেখেও শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের রক্ষণে গিয়ে ব্যর্থ হয় আর্জেন্টিনার সব প্রচেষ্টা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই প্রতি-আক্রমণে আরেকটি গোল খেয়ে বসে ম্যাচ থেকেই ছিটকে যায় আলবিসেলেস্তেরা। শেষ পর্যন্ত ৪টি গোল খেয়ে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নিতে হয় তাদের।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় আর্জেন্টিনার প্রতিবেশী ব্রাজিলের মাঠে। ইরানের বিপক্ষে বহু কাঠখড় পেরিয়ে লিওনেল মেসির গোলে ১-০’র জয় পায় আলবিসেলেস্তেরা। এরপর, একে একে সুইজারল্যান্ড, নাইজেরিয়া, বেলজিয়াম, হল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে তারা। সেখানে আবারও সেই জার্মানি। সমর্থকদের মনে আশা, অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েই কাপ হাতে নেবেন মেসিরা। খেলা চলে সমানে সমানে। তবে, গোলের সুযোগ বেশি পায় আর্জেন্টিনা। হিগুয়েনের গোল হয়ে যায় অফসাইড, ম্যানুয়েল নয়্যারকে একা পেয়েও গোল দিতে পারেননি প্যালাসিও, মেসির শট পোস্টে আর ঢোকে না! নির্ধারিত সময়ে ফল না হওয়ায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। কিন্তু বদলি খেলোয়াড় মারিও গোটশের গোলে এত কাছে গিয়েও শিরোপা ছোঁয়া হয়নি মেসিদের। সান্ত্বনার গোল্ডেন বল নিয়ে দেশে ফিরেন লিও।
সেই স্বপ্নভঙ্গের জ্বালা নিয়ে সুপারস্টার লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা রাশিয়া গেছে। অগোছালো একটা দল। প্রথম ম্যাচে মেসির পেনাল্টি মিস করায় নবীন আইসল্যান্ডের সাথে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয় তাদের। এরপর ক্রোয়েশিয়ার সাথে ৩-০ গোলে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ার আশঙ্কায় আলবিসেলেস্তেরা। মেসি বাহিনী কি পারবেন এখানে থেকে ঘুড়ে দাঁড়াতে? সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাতে একটি শিরোপা যে না হলেই নয়…
যমুনা অনলাইন: টিএফ
Leave a reply