মঞ্জুরুল ইকরাম:
রবীন্দ্রনাথ তার শেষের কবিতায় নিয়ে এসেছিলেন কাল্পনিক এক কবিকে, নাম নিবারণ চক্রবর্তী। তিনি চাইতেন এমন এক কবি আসুক, যার রচনা ‘তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো’। রবীন্দ্রনাথে বেঁচে থাকলে দেখে যেতে পারতেন, তার সেই কাল্পনিক, তারুণ্য ও সংগ্রামে দীপ্ত এক কবির পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়েছিল; এবং তা হয়েছিল আমাদেরই এই বাংলাদেশে।
শব্দের কারিগর নই, বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোকে তরঙ্গায়িত নদীর বহতা প্রদানে সক্ষম কোনো ভাষা বিপ্লবীও নই। কিন্তু যারা এই শব্দ নিয়ে খেলার ছলে গণমানুষের কথা বলে গেছেন তাদের প্রতি সম্মান জানাতে পারলে নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যায়। এই ক্ষণে শুরু করা যাক এভাবে, ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশে এমন কোনো আন্দোলন নাই যাতে রুদ্রর সশরীর অংশগ্রহণ ছিল না। কবিতা, গল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ, গান যেখানেই শিল্প সাহিত্য; সেখানেই রুদ্র। কবিতা আর বিদ্রোহ ছিল তার রক্তে।
ভীষণ এক খামখেয়ালীর জীবন ছিল তার। পারিবারিক স্বচ্ছলতা ছিল, সে পথে যাননি। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে বাঁধেননি। কয়েকটা রিকসা ছিল; তা থেকে যা আয় হতো তাতেই চলতেন। ঠিকাদারী করেছেন, চিংড়ির খামার করেছেন। আর দু’হাতে উড়িয়েছেন টাকা। পাঞ্জাবি আর জিন্সের যুগলবন্দি তখন বোধহয় তিনি একাই করেছিলেন। পরে জেমসের ক্যারিশমায় তা জনপ্রিয়তা পায়। ঋত্বিক ঘটকের মতোই ছিল রুদ্রর মদ্যপ্রীতি। প্রতি সন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা দিতেই হতো। জল বিনা তার যে চলে না! হুইস্কির বাংলাকরণ করেছিলেন ‘সোনালী শিশির’। এই নামে একটা গল্পও লিখেছিলেন রুদ্র। শেষ দিকে ধর্ম ত্যাগ করে মানবধর্ম গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন কাগজে কলমে। উকিলের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তার আগেই মৃত্যু তাকে ডেকে নিয়ে গেল গভীর এক ঘুমের দেশে।
প্রেমে আর দ্রোহে, সবখানে– স্বাধীনতা পরবর্তী কবিদের মধ্যে রুদ্রর মতো শক্তিমান খুব বেশি হয়তো নেই। রুদ্রকে অনেকে ৭০ দশকের কবি বলেন। এমনটা শুনতে খারাপ লাগে। সব বাধা ছিঁড়ে যে কবি বেরিয়ে এসেছেন, তার কাঁধে কেন দশকের জোয়াল! নির্ভেজাল এই মানুষটি ভণ্ডামি এবং ভণ্ডদের পছন্দ করতেন না। তাই নব্বইর পরে যখন কবিরা সব দলে দলে বিভিন্ন ঝাণ্ডার তলে আশ্রয় নিতে লাগলেন, তখন রুদ্র একা হয়ে গেলেন। প্রতিবাদে অনেকের অপ্রিয় হলেন। অবশ্য মৃত্যুর পর দেখা গেছে তারাই সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ রুদ্রর বন্ধুত্ব প্রচারে। শেষদিকে খুব নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন ‘ইচ্ছের দরোজা’র এই কবি। এই ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর একটি বিন্দুর মতো একা! নীলক্ষেতে কবি অসীম সাহার ইত্যাদি প্রেসে একটা চেয়ার বরাদ্দ ছিল তার জন্য। সেখানেই বসতেন। আড্ডা হতো। নতুন কাগজের স্বপ্ন দেখতেন। রুদ্রকে চিনতে হলে রুদ্র পড়ে চিনতে হবে।
মাটি ও মানুষের প্রতি আমূল দায়বদ্ধ এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে শক্তিমান কবির স্বীকৃতি। অকালপ্রয়াত এই কবি তার কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’- এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততোধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীকে। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। মাত্র ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো’সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
অমর এই কবির কাব্য প্রতিভার কাছে আজ নতজানু হয়ে বলতে হয়, ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। নতুন করে পড়া যাক অতি চিরসবুজের কবিতা। আজ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্মদিন।
‘…থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক,
একলা থাকার খুব দুপুরে একটি ঘুঘু ডাকুক…’
Leave a reply