দেড় যুগে ১২ খুন! নাটোরের বামিহাল গ্রাম আবারও অশান্ত

|

সিনিয়র করেসপনডেন্ট, নাটোর:

আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের জনপদ হিসাবে পরিচিত নাটোরের সিংড়া উপজেলার বামিহাল গ্রাম। গত ৯ সেপ্টেম্বর পাল্টাপাল্টি হামলায় জোড়া খুনের ঘটনায় পুরুষশূন্য গ্রামে এখন সুনসান নীরবতা। এর মধ্যে ১০ দিনের ব্যবধানে আরও একটি খুনের ঘটনা ঘটলো।

গত দেড় যুগের অধিক সময়ে চলা সংঘর্ষ ও হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই বাহিনীর তিন প্রধান এবং তিন পুলিশ সদস্যসহ মোট ১২ জন। হাত পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকেই। সন্ত্রাসী এই জনপদে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বামিহাল গ্রামকে বলা হয় রক্তাক্ত জনপদ। এখানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই সুকাশ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের পরাজিত ইউপি সদস্য প্রার্থী আফতাব আলীর সঙ্গে বর্তমান ইউপি সদস্য ফরিদুল ইসলামের বিরোধ চলে আসছিল। এরই জের ধরে গত ৯ সেপ্টেম্বর রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রথমে আফতাব গ্রুপের সমর্থকরা বামিহাল দশোপাড়া গ্রামে ফরিদুল সমর্থক রুহুল আমিনের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় রুহুল আমিনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করা হয়। পরে ফরিদুল সমর্থকরা আফতাব ও তার সমর্থকরা কালামের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসক আফতাব আলীকে মৃত ঘোষণা করেন। আহতদের মধ্যে রুহুল আমিন, কালামসহ তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন সকালে রুহুল আমিন মারা যায়। পরে নিহত দুই পরিবারের পক্ষ থেকে
পাল্টাপাল্টি দুটি মামলায় ৬২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১৫ জনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনায় উভয়পক্ষের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেফতার এড়াতে পুরুষশূন্য হয়ে যায় পুরো বামিহাল গ্রাম। আফতাব হত্যা মামলার প্রধান আসামি ইউপি সদস্য ফরিদুল ইসলামও আত্মগোপনে চলে যান। এরই মধ্যে বুধবার সকালে (১৯ সেপ্টেম্বর) সিরাজগঞ্জের সলংগা থেকে ফরিদুল ইসলামের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বামিহাল গ্রামের এক বৃদ্ধ জানান, পাল্টাপাল্টি মামলায় অপরাধ না করেও মামলার আসামি হয়েছেন বামিহাল গ্রামের অনেকেই। তাই গ্রেফতার আতংকে গা ঢাকা দিয়েছে গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ। তাই এখানকার নারী ও বৃদ্ধদের দিন কাটছে আতংকে, অনাহার আর অর্ধাহারে। এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আরও তৎপর হবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনটা প্রত্যাশা করেন তিনি।

সুকাশ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন বলেন, এই সন্ত্রাসী জনপদ হিসাবে বামিহাল পরিচিত পাওয়ায় জনপ্রতিনিধি হিসাবে তিনিও বিব্রত। যারা যেভাবেই ইন্ধন দিয়ে এই জনপদকে অশান্ত করে তুলেছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনবে প্রশাসন। এমনটা প্রত্যাশা করেন তিনি।

গ্রামের অধিকাংশ নারী, শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের দেখলেই দ্রুত বাড়ির ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। ভয়াবহ আতংক আর থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পুরো গ্রাম জুড়ে। নিহত পরিবারের লোকজনও তেমন কথা বলতে আগ্রহী না। নিহতের স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিশোধ নেবার কথা বলতে শোনা যায় সবাইকে।

সিংড়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জামিল আকতার জানান, খাসজমি, পুকুর দখলসহ নানাবিধ কারণে আফজাল ও ফরিদুল গ্রুপের সৃষ্টি হয়। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আফজাল মারা গেলে তার স্থান দখল করে আফতাব। পুনরায় শুরু হয় আফতাব আর ফরিদুল গ্রুপের সহিংসতা। বিবদমান দুটি গ্রুপের পাল্টাপাল্টি হামলায় বিভিন্ন সময়ে হাসেম আলী, আব্দুল মান্নান, চম্পা বেগম, শাজাহান আলী, আনসার আলী, সেলিম হোসেন নিহত হন। ২০০৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বামিহাল পুলিশ ফাঁড়ি লুটের ঘটনা ঘটে। এতে তিনজন পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দু’পক্ষের প্রধান ফরিদুল, আফজাল ও আফতাব আসামি ছিলেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর আফতাব বাহিনীর প্রধানসহ দুটি খুনের ঘটনা এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ফরিদুল খুনসহ নিয়ে দেড় যুগে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ ও হামলায় দুই বাহিনীর প্রধানসহ মোট ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর ভবিষ্যতে যেন এখানে হানাহানি, খুনাখুনি না হয় সেজন্য কঠোর অবস্থানে আছে তারা। ইতোমধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আফতাব হত্যা মামলায় নাজিম উদ্দিন নামে একজনকে এবং রুহুল হত্যা মামলায় রবিউল ইসলাম, আলী হাসান, জুয়েল ইসলাম, হাবিবুর রহমান নামে চারজনকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করে। অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে। পুরো গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা আছে। বামিহালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে।

ইউএইচ/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply