ঝিনাইদহে ফসলি জমির ‘টপ সয়েল’ চলে যাচ্ছে ইটভাটায়, উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা

|

জমির উপরিভাগের উর্বর অংশ কেটে ইটভাটা মালিকেরা নিয়ে যাচ্ছে ইট তৈরিতে।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি:

ক্ষেতে ভালো ফসল উৎপাদনে জৈব উপাদান বেশি দরকার। তা থাকে মাটির উপরিভাগে। সেই উর্বর অংশ কেটে ইটভাটা মালিকেরা নিয়ে যাচ্ছে ইট তৈরিতে। এ জন্য ভাটা মালিকেরা সহজ-সরল কৃষকদের টাকার লোভনীয় অফারে দুর্বল করছেন। এখন এলাকার অধিকাংশ ইটভাটায় এভাবে ফসলি জমির মাটির উর্বর অংশ পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ইট। তাই তো ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মাঠে মাঠে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে। মাঝে মধ্যে প্রশাসন হানা দিলেও অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হচ্ছে না।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়নের দাপনা গ্রামের মাঠে হাশেম আলীর ফসলি জমিতে ভেড়ানো রয়েছে মাটি কাটা ভেকু। পাশেই পরপর ভেড়ানো রয়েছে ৬টি মাটি টানার ট্রাক্টর। এ ট্রাক্টরে মাটি ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলাকান্দর গ্রামের একটি ইটভাটায়। বলাকান্দর মাঠে দেখা যায় অন্য আরেকটি ফসলি জমির মাটিও কেটে নেয়া হচ্ছে নিকটবর্তী একই ইটভাটায়। মস্তবাপুর মাদ্রাসার পাশের জমি থেকেও মাটি কেটে ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য আরেকটি ইটভাটায়।

প্রতি ট্রাক্টর মাটি বিক্রি হচ্ছে নয়শো থেকে হাজার টাকায়।

একই দিন উপজেলার আরও বেশ কয়েকটি মাঠে দেখা যায়, প্রায় সব গ্রামের মাঠের মধ্যেই ফসলি জমির মাটি কেটে একইভাবে ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্থানীয় নিকটবর্তী ইট ভাটাগুলোতে। এতে জমির উপরি নরম মাটি আর ক্ষেতে থাকছে না। মাটি বহনে মাঠে মাঠে কয়েক শত ট্রাক্টর নামানো হয়েছে। যে ট্রাক্টরগুলোর মধ্যে কিছু স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীরা মালিক। তবে বেশির ভাগই আশপাশের যশোর, নড়াইল, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া জেলা থেকেও মাটি কাটা ভেকু ট্রাক্টর ও শ্রমিক বিশেষ চুক্তিতে এনেছেন ভাটা মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীরা।

আবার মাটি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নিজেরা ট্রলি কিনে নিয়েছে। তারা বিশেষ করে আমন ধান কাটার পর শুকনো জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে থাকে।

পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে ভেকু, ট্রাক্টর ও শ্রমিক।

বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের অভিযোগ, কালীগঞ্জ উপজেলার মাঠে মাঠে এখন মাটি কাটা ভেকু। এ ভেকু দিয়ে নির্ভয়ে ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। এগুলোর অধিকাংশ অন্য জেলা থেকে ঘণ্টা চুক্তিতে মাটি ব্যবসায়ী ও ভাটা মালিকেরা এনেছেন। তারা জানান, বেশির ভাগই আশপাশের মাগুরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল ও পাবনা জেলা থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। সাথে আনা হয়েছে মাটি টানা ট্রাক্টর ও শ্রমিক। তারা স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইটভাটায় মাটি দিচ্ছেন। তারা প্রভাবশালী হওয়ায় কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ।

নলডাঙ্গা এলাকার মাটি ব্যবসায়ী পিকুল হোসেন জানান, তিনি প্রতি ট্রাক্টরের ট্রলি মাটি বিক্রি করছেন ৯’শ থেকে ১ হাজার টাকায়। একটু দূর হলে আরও বেশি। তিনি বলেন, ইটভাটায় তিনি মাটি দেন না। শুধুমাত্র বাসা বাড়ি নির্মাণের সময়ে কেউ আসলে তাদের কাছে মাটি বিক্রি করে থাকেন।

উপজেলা আরেক মাটি ব্যবসায়ী এনামুল মিয়া জানান, তারা তাদের এলাকায় মাটির ব্যবসা করেন। প্রতি টলি মাটি ৮’শ থেকে সাড়ে ৮’শ টাকায় বিক্রি করছেন। দূরত্বে বেশি হলে দাম আরেকটু বেশি। তিনি গত এক সপ্তাহ আগে মাটির ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।

এদিকে এ ব্যাপারে উপজেলা কয়েকটি ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।

এভাবে চলতে থাকলে একসময় মাটি উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

কালীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হাবিবুল্লাহ জানান, আমি এ উপজেলাতে যোগদানের পর গত ১ বছরে খবর পেলেই মাটি কাটা বন্ধ করতে শুরু করেছি। এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক স্পটের মাটি কাটা বন্ধ করেছি। সম্প্রতি প্রয়োজন মতো ১১টি স্পটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানার আওতায় এনেছি।

এ বিষয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন (কৃষি) মহাপরিচালক (ঢাকা) মো. কামরুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের মাটিতে সোনা ফলে। যে কারণে মাটি সবচেয়ে বড় সম্পদ। এ সম্পদ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তিনি বলেন, মাটির উপরের যে জৈব উপাদানে ভরা ‘টপ সয়েল’ তা ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই প্রয়োজন। এমন মাটি একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার বছরের পর মাটির উপরিভাগ এমন অধিক উর্বর ও উৎপাদন উপযোগী হয়। সেটা অসচেতনতায় হোক অথবা কারও সামান্য কিছু অর্থের লোভে হোক বিক্রি করা হয়। তা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মত। আর এভাবে চলতে থাকলে তো একদিন আমাদের মাটি উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। ফলে মাটি রক্ষায় আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

এএআর/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply