যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির মেমফিসে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ টায়ার নিকোলসের ওপর পুলিশের নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের ঔচিত্য নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা। পুলিশের বডিক্যামে ধরা পড়া নির্যাতনের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো অনেকের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার ২৯ বছর বয়সী টায়ার নিকোলসের মৃত্যু ঘটেছে তাকে হাসপাতালে ভর্তির তিনদিন পর। প্রতিবাদ চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহরে। তবে অনেকের মতেই, নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ করা উচিত হয়নি পুলিশের। আবার, সত্য উদঘাটনের জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন অনেকে। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে বিবিসিতে।
জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে টায়ার নিকোলসের সাথে ছিল অ্যাঞ্জেলিনা প্যাক্সটনের বন্ধুত্ব। শৈশব, কৈশোরে তাদের বিকেলগুলো কাটতো স্কেট পার্কে গাড়ির ছাদে বসে ক্যালিফোর্নিয়ার সূর্যাস্ত দেখে। ২০২০ সালে সবশেষ মেমফিসে এসেছিলেন অ্যাঞ্জেলিনা। শেষবারের মতো তখনই নিকোলসের সাথে সূর্যাস্ত দেখেছিলেন তিনি। তিন বছর পর অ্যাঞ্জেলিনার সামনে আসে নিকোলসকে নির্যাতনের ভিডিও; যখন আর বেঁচে নেই তার বন্ধু। এই ভিডিও দিয়ে নিকোলসের সাথে কাটানো সময় ও স্মৃতিগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে চান না বলে জানিয়েছেন অ্যাঞ্জেলিনা। বলেন, এই ভিডিও না দেখার জন্য সব চেষ্টাই করেছি। আমি চাই না তার সম্পর্কে আমার সবশেষ স্মৃতি হিসেবে এমন ভয়ংকর কিছু থাক।
টেনেসি পুলিশ জানিয়েছে, স্বচ্ছতার জন্য প্রায় এক ঘণ্টার ফুটেজটি প্রকাশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তবে অনেক আমেরিকানই এমন ফুটেজ প্রকাশের যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের মধ্যে অ্যাঞ্জেলিনার মতো আছেন নিকোলসের মা রাউভন ওয়েলস। তার মতে, পাশবিক নির্যাতনের খবর শোনাই যথেষ্ট ছিল।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, জাত-বর্ণ নির্বিশেষে অনেকেই এমন ভিডিও দেখে মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে পারেন। বর্ণগত মানসিক ট্রমা নিয়ে গবেষণা করা মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অ্যালেক্স পিটার্স বলেন, কালো এবং বাদামি বর্ণের মানুষের ইতিহাসে এমন অনেক সন্ত্রাস ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার প্রেক্ষিত রয়েছে। তাই যখনই কেউ এমন ভিডিও দেখবে, সে কেবল সেই ভিডিও নয়; তার সামনে যেন আমেরিকার বর্ণ বৈষম্যের পুরো ইতিহাসটাই জীবন্ত হয়ে উঠবে। আমি কাউকে এই ভিডিওটি দেখতে নিষেধ করবো না। তবে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এটি এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে।
কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে হওয়া বর্ণ বৈষম্য নিয়ে কাজ করা ইয়েল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. আমান্দা ক্যালহানের মতে, এসব ভিডিও এড়িয়ে যাওয়ার পেছনে যেসব প্রবণতা কাজ করে তার অধিকাংশই যৌক্তিক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে আর যাই হোক, এই ফুটেজ খুব সহায়ক কিছু হবে না। সেই সাথে তিনি বলেন, আপনি যদি ভিডিওটি দেখতে চান, সত্যিই কী ঘটেছে তা জানতে চান; আমার মতে সেটিতেও ভুল নেই। আমি কেবল মনে করিয়ে দিয়ে চাই, এর ফলে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
ডক্টর পিটার্স এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে বলেন, টায়ার নিকোলসের মৃত্যুর কাভারেজ আপনাকে কেমন অনুভব করায় তা পরীক্ষা করে দেখুন। তবে সেটা তখনই, যদি আপনি আগেও সহিংসতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। আপনি যদি এটি দেখতেই চান তবে, আগে অনুধাবন করুন যে এর ফলে আপনার অতীত স্মৃতিগুলো সামনে চলে আসছে কিনা। তাই সতর্ক হওয়ার কথাই বলবো।
ড. আমান্দা ক্যালহান বলেছেন, ভিডিওটি দেখা বা এর সম্পর্কে শোনা মাত্রই মাথা কিংবা বুকে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে কিনা, তা দেখা জরুরি। শরীর এ সম্পর্কে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার উপরও নির্ভর করবে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এমন সহিংস ফুটেজের প্রভাব। সেই সাথে আরও কিছু প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন, মনোভাব পাল্টে যাওয়া, ক্ষুধা ও ঘুমের অভাব, আগে যেসব বিষয়ে আনন্দ হয়েছিল এখন সে সবে নির্লিপ্ত থাকা। যদি এসব ঘটে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ড. অ্যালেক্স পিটার্স বলেন, স্বাভাবিক বিবেচনা মতে মনে করি, এ দেশে আপনার বর্ণ কী, সেটা নিয়ে কী ভাবছেন, কী অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে, এসব নিয়ে মানসিকভাবে সহিংসতায় ভুগছেন কিনা- তা নিয়ে খুব নিয়ে আলোচনা হয় না। আলোচনা করার ক্ষেত্রও খুব প্রশস্ত নয়। তবে, আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি, তা সহিংস হলে সেটাই সত্যি। আর এসব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেয়াই এমন সময়ে বিশ্বকে আমরা কোন চোখে দেখবো তা নির্ধারণ করে দেবে।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের মৃত্যু; মাকে ডাকছিলেন নিকোলস
/এম ই
Leave a reply