অপূর্ব আলাউদ্দিন:
‘আমি শরীফ, দুদক চট্টগ্রাম থেকে বলছি। আমি কি নোটিশ পাঠিয়ে দিবো নাকি আপনি আসবেন সরাসরি। কোনটা?’— মুঠোফোনে এভাবেই কথা বলছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকুরিচ্যুত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন। নোটিশ না দিয়েই কল করে যে কাউকে ডেকে আনতেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (আইন ও প্রসিকিউশন) মইদুল ইসলাম বলেন, আসামির সঙ্গে তখন কথা বলা হবে, যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সেটি তো অফিসে (দুদক কার্যালয়ে) বসে সামনাসামনি করতে হবে। কিন্তু ইনফরমাল যে আলাপ, সেটির তো অনুমতি নেই।
তদন্তের নামে আদালতের আদেশ ছাড়া শরীফ উদ্দিন জব্দ করেন ৩৩টি ব্যাংক হিসাব। আইন-বিধি না মেনে তদন্ত করেন একের পর এক মামলা। কক্সবাজারে নিজস্ব সোর্স নিয়োগ করে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মামুন মাহবুব জানান, আদালতের অনুমতি ছাড়া ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে না।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারে র্যাব ৯৩ লাখ টাকাসহ এক সার্ভেয়ারকে আটক করে। শরীফ উদ্দিন ওই মামলার বাদী। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবেও নিযুক্ত হন তিনি। যমুনা নিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, র্যাব যে চারটি প্রকল্পের ৭ বস্তা নথি উদ্ধার করেছিল, সেদিকে না গিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এদিকে, আরও বেরিয়ে আসে, দুদকের চাকুরিচ্যুত এই কর্মকর্তার নিয়োগ করা সোর্সরা শরীফের হয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন। এসব সোর্সদের মধ্যে খোরশেদ আলম একজন। এই সোর্সই কল করেছিলেন ভুক্তভোগী অ্যাডভোকেট নেজামুল হককে।
এই আইনজীবী বললেন, খোরশেদ নামে একজন কল দিয়ে বলে, আপনার একটা সমস্যা আছে। যদি আপনি দেখা না করেন তাহলে বিপদ হবে। এরপর চট্টগ্রাম গিয়ে উনার সাথে আমি দুইবার দেখা করেছি। সেখান থেকে খোরশেদ সরাসরি শরীফের সাথে কথা বলেছে।
ওই বৈঠকের কথোপকথন রেকর্ড করে রেখেছিলেন নেজামুল হক। রেকর্ড করা সেই কথোপকথনে খোরশেদকে বলতে শুনা যায়, শরীফ ১ কোটি টাকা চাইবে। তবে শরীফকে টাকা দিবেন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। আমি সেভ (রক্ষা) করে দিবো। কিন্তু আপনি ছেঁচড়ামি করবেন না। পারবেন না বলবেন না, বললে ফেঁসে যাবেন।
নিশ্চয় এতক্ষণে মনে প্রশ্ন আসতে পারে কে এই নেজামুল হক। তিনি কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল এডভাইজার হিসেবে কাজ করেন নেজামুল হক। তার দুইটি ব্যাংক হিসাবও নো-ডেবিট করা হয়। এরপর তার সাথে শরীফের সোর্স যোগাযোগ শুরু করেন।
খোরশেদের সাথে বৈঠকের পর শরীফ নিজেই ফোন করেন নেজামুল হককে। ফোনকলে শরীফ বলেন, আমি আমার প্রতিবেদনে লিখেছি, ইলিয়াস ব্রাদার্সকে অন্যায়ভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। এবং এই জায়গার ২৯ কোটি টাকার মধ্যে তারা কমপক্ষে ১৪-১৫ কোটি টাকা পাবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মামুন মাহবুব বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে কী দেবে সেটি আলোচনা করা মানে তো বিবাদীকে প্রলুব্ধ করা। তাতে অন্য গন্ধ পাওয়া যায়।
এই ঘটনায় সামনে আসে শরীফের আরেক সোর্স আরিফুল হাসান। দফায় দফায় এই সোর্স নেজামুল হকের সাথে বৈঠক করেন।
নেজামুল হক বলেন, আরিফ আমার চেম্বারে আসে, বলে আপনি ১ কোটি টাকা দেবেন না। ৫০ লাখ টাকা দেবেন।
শেষ পর্যন্ত চুক্তি হয় ৩০ লাখ টাকায়। যা ফোনকলে শরীফকে জানানো হয়। শরীফের সাথে ফোনকলে আরিফ বলেন, পিবিআই-এ নেজামুল হক ভাইয়ের ফাইলটা ছাড়া আর কোনো ফাইলের ব্যাপারে তদবির নাই। কোনো কথা নেই। আপনি নেজাম ভাইয়েরটা রেডি করে… আর বৃহস্পতিবার…।
এ সময় মুঠোফোনের অপরপ্রান্তে থাকা শরীফ বলে উঠেন, ওইটা তো আপনি বলছেন। জবাবে আরিফ বলেন, ওটা যেভাবে কথা হয়েছে, ওটা চূড়ান্ত…। তখন শরীফ বলেন, ঠিক আছে ভাই, বৃহস্পতিবার দেখা হবে।
নেজামুল হক বললেন, আরিফ ওইদিন বা তার পরের দিন চট্টগ্রামে গিয়ে শরীফের ভাইয়ের হাতে হাতে টাকা দিয়েছে।
২০ লাখ টাকা লেনদেনের পর ব্যাংক একাউন্ট খুলে যায় নেজামুল হকের। আর সেটি নিশ্চিত করেন শরীফ নিজেই। মুঠোফোনে বলেন, খোরশেদের কথাও বিশ্বাস করিয়েন না। আরিফের কথাও না। আপনার যে টাকাটা আমি জব্দ করছি, টাকাটা ছেড়ে দিছি না ভাই? তার মানে বুঝতে পারছেন। আমি তো বেলায়েতেরটা ছাড়ি নাই। ইদ্রিসেরটা ছাড়ি নাই।
এবার বাকি ১০ লাখ টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন আরিফ। মুঠোফোনে নেজামুল হককে বলেন, আপনি আমার বিষয়টা বিবেচনা করেন। আমি মাগরিবের পর আপনার সাথে দেখা করবো।
কী কারণে শরীফকে টাকা দিয়েছিলেন নেজামুল হক? এই আইনজীবী জানালেন, ইলিয়াস ব্রাদার্স এখানে ১৪-১৫ কোটি টাকা পাবে। উনি টাকাগুলো ক্লায়েন্ট এবং আমার টাকাগুলো আামাকে দিয়ে দিবে। পরবর্তীতে দেখলাম যে, টাকা দিচ্ছে না। তখন আমি শরীফকে ভয়েস মেসেজ পাঠাই।
ভয়েস মেসেজে নেজামুল হক বলেন, আরিফের মাধ্যমে আপনি ব্যাংকে থাকা ৩০ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন, এটা কিন্তু আমার মেয়ের মেডিকেলের ভর্তির টাকা। আপনি যদি কোনো মাধ্যমে কাইন্ডলি আমার টাকাগুলো দিয়ে দেন, তাহলে আমি উপকৃত হবো।
এই মেসেজ পেয়ে একদিন পরই নেজামুলকে টেলিফোন করেন শরীফ। বলেন, যেটা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। আপনি আপনার মেয়েকে মেডিকেলে পড়ান। দেশের সেবা করেন। আমার জন্য দোয়া করতে বলবেন। আরিফের কাছ থেকে আপনাকে টাকাগুলো উদ্ধার করে দিচ্ছি।
নেজামুল হক স্পষ্ট করেন ত্রিশ লাখ টাকা দেয়ার বিষয়টি। প্রথমে তো ২০ লাখ টাকা শিহাবের হাতে দিয়ে আসা হয়। এরপর ১০ লাখ টাকা দেয়া হয় কুরিয়ার সার্ভিস বা অন্য কোনোভাবে।
এরপর এস এ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের ৫ লাখ টাকার একটি রশিদ যমুনা নিউজের কাছে আসে। এটি যাচাই করতে কুরিয়ার সার্ভিসটির কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ শাখায় যায় প্রতিবেদক। নিশ্চিত হওয়া যায়, রশিদটি সঠিক।
রশিদের তথ্য অনুযায়ী, টাকা পাঠিয়েছেন হাসান। কিন্তু মোবাইল নম্বরটি আব্দুল্লাহ আল নোমান রুবেলের নামে। টাকা তুলেছেন আতিকুর রহমান। মোবাইল নম্বরটিও তার নামে। এই আতিক শরীফের ভাই শিহাবের বন্ধু।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এই আতিকের নামে আরও দুইটি মোবাইল নম্বর আছে। যেগুলো ব্যবহার করেন শরীফ নিজেই।
এসব বিষয়ে আতিককে জিজ্ঞেস করা হলে চুপ থাকেন তিনি। এ সময় শরীফকে ফোন দিতে বলা হলে কল দেন আতিক। শরীফ ফোন না ধরলেও কল ব্যাক করেন তার ভাই শিহাব। আর জানতে চায়, সাংবাদিকরা কী আছে?
আতিকের কললিস্ট বলছে, তিনি দফায় দফায় শরীফের সাথে কথা বলেন।
ওদিকে, কুরিয়ারের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর মুঠোফোন নাম্বার অনুযায়ী আব্দুল্লাহ আল নোমান রুবেলের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, ৫ লাখ টাকা তিনি লেনদেন করেননি।
নিজের এনআইডি কার্ড নিয়ে কাউকে সিম কিনে দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে রুবেল বলেন, মনে হয় আরিফ ভাই। কেন আরেকজনকে সিম তুলে দিয়েছেন, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উনি আমার থেকে সিম নিয়েছেন।
এরপর শরীফের সোর্স আরিফুল হাসানের সাথে কথা হয় সামনাসামনি। প্রথমে পুরো বিষয়ে অস্বীকার করেন। পরে অডিও রেকর্ড শোনানোর পর বদলে যায় তার চেহারা। জানালেন, কেন শরীফকে টাকা পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
আরিফ বলেন, ও তখন এখানকার বারাক ওবামা। ওর কথা না শুনলে শ্যুট, গ্রেফতার।
এসব বিষয়ে শরীফের বক্তব্য জানতে তার সেই দোকান ও বাসভবনে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তার সবগুলো মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
/এমএন
Leave a reply