মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক:
যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম বাবুলকে আমরা অনেক সময় বাবলু ভাই বলেও ডাকতাম। উনার পরিবারের সাথে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। আমার রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও ভাইয়ের অবর্তমানে আগের মতো যোগাযোগ হয়ে উঠে না।
বাবলু ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গেলে মনের মধ্যে অনেক বেদনা জমে উঠে। আবার অনেক আনন্দও জমে উঠে। উনার সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৫ সালে। তখন যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর মাত্র গোড়াপত্তন হচ্ছে। তখন উনার অফিস ছিল মতিঝিল থেকে ইত্তেফাক মোড়ের দিকে যেতে ওয়াপদা ভবনের নিচতলায়, এক রুমের অফিস। সেখানে যাতায়াত করতাম। পরে তো সেনা কল্যাণ ভবনে চলে গেলেন। তারপর সেখান থেকে যমুনা ফিউচার পার্কে চলে যায় অফিস।
১৯৭৫ এর শেষদিকে কিংবা ১৯৭৬ এর শুরুর দিকে আটরশি গিয়েছিলাম, বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে। বাবলু ভাইও গিয়েছিলেন। উনার সঙ্গে এক গাড়িতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমরা ২-৩ রাত ছিলাম, গল্প-আলাপে আমাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে। তারপর থেকে উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের পরিবারের মধ্যে অত্যন্ত নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
উনি বন্ধুবৎসল ছিলেন। যত মানুষ উনার সাথে দেখা করতে আসতেন, উনার সমবয়সী বা পুরনো মানুষ, সবার সাথে খোলামনে আলাপ করতেন। আপদে-বিপদে তিনি সুপরিচিত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি কখনও কাউকে না করেননি। উনি হাতখোলা মানুষ ছিলেন। অর্থাৎ কর্মচারী, শুভাকাঙ্ক্ষীর বিপদে পাশে দাঁড়াতেন।
তিনি একজন শিল্পপতি ছিলেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি উনি সৎ শিল্পপতি ছিলেন এটাও সত্য। অর্থাৎ কর বা সরকারের কোনো নীতি ফাঁকি দিয়ে বড় হতে চাননি। আর তিনি কোনোদিন ঋণ খেলাপি হননি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া উনার চরিত্রের মধ্যে ছিল না। এখনকার সময়ে এটা খুবই ব্যতিক্রমই চরিত্র। বর্তমানে নুরুল ইসলাম বাবুলের মতো শিল্পপতি পাওয়া খুবই মুশকিল। যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সময়মতো ফেরত দিচ্ছে। উনি অনেকগুলো শিল্প উদ্যোগ নিয়েছেন। এসব উদ্যোগের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান দেখতে আমরা বিভিন্ন সময়ে গিয়েছি। উনি সবসময়ই বলতেন, ইবরাহিম ভাই আসেন, দেখে যান। সেজন্য দেখতে গেছি।
উনি কষ্ট করে বড় হয়েছেন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাবলু ভাই সন্তানদের মানুষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আল্লাহর রহমতে, উনার এক পুত্র ও তিন কন্যা সুশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। আর তাদের মা অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম আমাদের বড় আপার মতো।
উনার সাথে আমার একটা স্মৃতি আছে। কোনো এক শুক্রবার আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় যমুনা শিল্প পার্কের উদ্দেশে। তখন শিল্প পার্ক স্থাপনের কাজ পুরোদমে চলছে। আমি যাবো দেখে উনি (নুরুল ইসলাম বাবুল) স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিলেন। তাদের বললেন, মেজর জেনারেল ইবরাহিম আসবেন, আপনারাও আসেন। ঘটনাক্রমে ওই এলাকাটি ছিল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র। আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র অবশ্য অনেক বড় ছিল।
যাই হোক, উনি উনার পুরো শিল্প পার্কটা হেঁটে হেটে দেখালেন। মজার বিষয় ওখানে তো অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল, শুধু টায়ার ফ্যাক্টরি না। তো উনি শ্রমিক বা কর্মকর্তাদের নিয়ে বসলেন। তখন আমরা পেছনে বসলাম। উনার কথাগুলো শুনছিলাম। উনি ব্যবস্থাপক ও পরিকল্পনাকারী কতটা পরিণত, তা আমরা বুঝতে পারি। আমি একবাক্যে বলবো, উনি সুদক্ষ পরিকল্পনাকারী ছিলেন। ভবিষ্যতকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাতেন। স্বাধীনতার পর উনি শূন্য থেকে প্রায় ৪০টা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। আমি যমুনা গ্রুপের মালিক ও আমাদের বন্ধু নুরুল ইসলাম বাবুলের আত্মার মাগফিরাত করছি।
উনার যুগান্তর পত্রিকার পরিকল্পনার সময় দাওয়াত দিয়েছিলেন, যেন পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকি। আমি ২০২০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত লিখেছি। এরপর সময়ের অভাবে আর লেখা হয়ে উঠছে না। তাই যুগান্তরের সাথে আমার সম্পর্কটা গভীর। যুগান্তর প্রকাশিত হওয়ার প্রথম ৯০ দিনের মধ্যে আমি ৩৬ দিন কলাম লিখেছি।
উনি বিরাট ক্যানভাসে চিন্তা করেছেন। মানুষের কল্যাণ করতে চেয়েছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে কর্মসংস্থানে আনার কাজ করেছেন। উনার শিল্প প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক কর্মী যুক্ত। মানুষের আর্থসমাজিক কল্যাণের জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ এক শিল্প উদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি প্রচণ্ড রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। আমি সচেতনভাবেই প্রচণ্ড শব্দটা ব্যবহার করছি। উনি আমাকে বলতেন দাদা আসেন। আমাকে দাদা সম্বোধন করতেন। আমিও দাদা বলতাম। উনি তখন উনার চিন্তাগুলো শেয়ার করতেন। তিনি যেহেতু মাঠে-ময়দানে কাজ করে বড় হওয়া শিল্পপতি ছিলেন, তাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অসংগতিগুলো দেখতেন। আর রাজনীতির ভুলগুলো এর সঙ্গে মেলাতেন। উনার কথাগুলো একদম প্র্যাক্টিক্যাল ছিল।
আমার জানা মতে, তিনি কোনোদিন শ্রমিকের পাওনা বকেয়া রাখেননি। আর এমন কোনো জীবনযাপন করেননি, যেটা মানুষের চোখে দৃষ্টিকটু ঠেকে। তাই উনাকে আমি ব্যতিক্রমী শিল্পপতি বলি।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।
Leave a reply