নানামুখী সংকটের মধ্যেই তালেবান শাসনের দুই বছর পূর্ণ হলো আফগানিস্তানে। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হলেও ক্রমেই অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে দেশটির সাধারণ মানুষের ওপর। তার ওপর আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সাথে নেই কোনো কার্যকর আলোচনা। বেকারত্ব, খাদ্য ও পুষ্টির অভাব বেড়েই চলেছে। জঙ্গিগোষ্ঠি আইএসের চোরাগোপ্তা হামলাও বড় দুশ্চিন্তা আফগানদের জন্য। তবে আলোচনায় আসতে পারেন আফগান নারীরা। অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তালেবান ক্ষমতাগ্রহণ করলেও বর্তমান চিত্র দেখলে স্পষ্ট হবে, আফগান নারীদের মুছে ফেলা হচ্ছে সব জায়গা থেকে। সিএনএনের খবর।
২০ বছর বয়সী আফগান নারী জাহরা যখন ২০২১ সালের গ্রীষ্মের দিকে তাকান, সেই স্মৃতিকে তার মনে হতে পারে ভিন্ন কোনো বাস্তবতা। শিক্ষার্থী হিসেবে তার ছিল অনেক বন্ধু। জাহরা বলেন, আমরা এতসাথে খুবই আনন্দে ছিলাম। পড়াশোনা করতাম, আড্ডা দিতাম, এতসাথে বাইকও চালাতাম।
জাহরা এখন আর বাইক চালান না। স্কুলেও যান না। মুখ না কোথাও যাওয়া আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। দেশ ছেড়ে চুলে যাওয়া বন্ধুদের সাথে দেখা করা তো তার চিন্তারই বাইরে! ঘরে চুপচাপ বসে নিজ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। জাহরা বলেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাই। দুই বছর আগের আমি’র সাথে এখনকার আমার অনেক পার্থক্য চোখে পড়ে। অতীতের কথা ভেবে তখন খারাপ লাগে।
আর এটাই এখন আফগান নারীদের বাস্তবতা। নতুন করে ক্ষমতা দখলের পরপরই নানা সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল তালেবান। বিদেশি বিনিয়োগ, বেকারত্ব দূর আর নারীদের শিক্ষার সুযোগের কথা বলা হলেও বাস্তবের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। শিক্ষার পরিবেশ আর কাজের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে নারীদের জন্য। এইচআরডব্লিউ’র সহযোগী পরিচালক হিদার বার বলেন, গেল দুই বছর আফগানিস্তানে নারীর অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সবচেয়ে বাজে বিষয়টি হলো, এই যে পরিবর্তন এটাকে সবাই মেনে নিয়েছেন। তালেবান নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর নারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে নারীদের বিভিন্ন সুযোগের ওপর।
২০২১ সালে ক্ষমতার আসার পর ধীরে ধীরে নারীদের মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের অধিকার কেড়ে নেয় তালেবান সরকার। নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, জাতিসংঘসহ যেকোনো এনজিওতে কাজ করা হয় নিষিদ্ধ। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও নারীদের ওপর দেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। পার্ক, জিমনেশিয়ামসহ জনসমক্ষে নারীদের চলাফেরার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়।
ধীরে ধীরে সকল জায়গা থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ মুছে ফেলার কাজ করে চলেছে তালেবান সরকার। গত জুলাই মাসে আফগানিস্তানের সকল বিউটি সেলুন বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয় তালেবানরা। এই কাজে নিয়োজিত ছিল দেশটির প্রায় ৬০ হাজার নারী। জীবন ও জীবিকার চাহিদা মেটানোর জন্য এটিই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন।
পরিবর্তিত অবস্থা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আফগান নারীদের মানসিক সুস্থতায়। গত মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবসাদ এবং আত্মহত্যার সংখ্যাও আফগান সমাজে বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা এবং আর্থিক টানাপোড়েনের ফলে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী আফগান নারীরাই সবচেয়ে বেশি ভুগছে বলে জানানো হয়েছে সেই প্রতিবেদনে। জরিপে অংশ নেয়া ৮ শতাংশ নারীই এরমধ্যে অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে জানানো হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে, পারিবারিক সহিংসতা এবং জোরপূর্বক বিবাহের হারও বেড়েছে দেশটিতে।
জাহরার মতো নারীদের কাছে আফগানিস্তানের বর্তমান সমাজ বাস্তবতা হয়ে ওঠেছে দুর্বিষহ; যেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক চিন্তার কোনো অবকাশই নেই। শিল্পপ্রেমী জাহরা চেয়েছিলেন ফ্যাশন ডিজাইন হতে, নিজের ব্যবসা শুরু করতে। কিন্তু বর্তমান আফগানিস্তানের তার এই স্বপ্নের কোনো স্থান নেই। যেমন নেই তার মতো লাখ লাখ নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য।
/এম ই
Leave a reply