ফয়েজ বিন হাকিম:
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দেশ। নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা গ্রামকে কেন্দ্র করেই শত শত বছরের রূপলাবণ্যেও বাংলাদেশ। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত রূপসী বাংলার নান্দনিক মায়া মুগ্ধ ছবি দেখলে মন ভরে যায়। নদীবিধৌত বাংলায় নদী-নালা, খাল-বিলই আমাদের আসল সম্পদ। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কার অত্যাবশকীয় হয়ে উঠছে।
গ্রামের মুরব্বিরা এখনও বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কৃষিকাজ অব্যাহত রেখেছে। আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না, তাদের নির্ভুল দিনক্ষণের গণনা দেখে। মুহূর্তের মধ্যে বলে দিতে পারেন বাংলা মাসের নাম ও কত তারিখ; কবে পূর্ণিমা, কবে অমাবস্যা এমনকি কোন মাসের কত তারিখের মধ্যে কোন ফসল বুনতে হবে। আকাশের তারা দেখে, সূর্য দেখে আনুমানিক সময় বলে দিতে পারেন। যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কৃষিখাত অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, তাই কৃষি পর্যটনে প্রসার খুব সহজে সম্ভব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অতুলনীয় এই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন নীতিমালার আলোকে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় এই খাতের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হয়েছে।
পর্যটকদের অভিমত, যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে শুধু পর্যটনশিল্প থেকেই বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। পৃথিবীর যেকোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করার মতো সকল উপাদান বাংলাদেশে আছে।
পর্যটন খাতে বিনিয়োগের বর্তমান পরিস্থিতি:
দিন দিন বাংলাদেশে র্প্যটনে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে দারুণ সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে খাতটি। ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন?
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বহাল রাখতে পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দেয়া একান্ত প্রয়োজন মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য যে, কোভিড মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেলেও তবে ধীরে ধীরে এই সংখ্যা আবারও বাড়ছে। বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতে আছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এর ভেতর সরাসরি জড়িত আছেন ১৫ লাখ, আর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছেন প্রায় ২৩ লাখ।
এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করছে। এই সংখ্যাটি সন্তোষজনক হলেও এর মাত্র ২ শতাংশ বিদেশি।
পর্যটন খাতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান তথা মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইপিই গ্লোবাল লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের পর্যটন নতুন যুগে প্রবেশ করবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের পর্যটন শিল্পের চিত্র বদলে যাবে। বাড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে।
এই শিল্পকে লুফে নিয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, মরিশাস, মালদ্বীপ। যে সব দেশ কঠোর রক্ষণশীল বলে পরিচিতি যেমন চীন, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার— তারা এ শিল্পের ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে তাদের সীমান্ত দ্বারে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। অথচ এসব দেশ এক সময় বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ রেখেছিল। এর ফলে এসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভ্রমণ আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পর্যটনের নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ছে। শিল্পে প্রতিযোগিতা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যে এগিয়ে যাবে, জয়ও তার সঙ্গে অগ্রসর হবে।
পর্যটন শিল্প বিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের কপালে জ্বলজ্বল করছে। এখন এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলে এ শিল্প এখানে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। পর্যটনের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই একমাত্র উদ্যোগ। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতার কথা সব ক্ষেত্রেই আমাদের শোনা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তাই পর্যটনে কিছু বৈচিত্র ও সুযোগ সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলোতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলাসহ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনারগাঁ, সিলেটের জাফলং, মাধবকুণ্ড, হামহাম বা শেরপুরের ঝিনাইগাতি, নকলা বা গজনীকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপায়িত করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে জায়গাগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড় এলাকার চা বাগান, হাওড়বিল এলাকা বা আকর্ষণীয় স্থানে পর্যটন সুবিধা নিশ্চিত করে এই শিল্পের বিকাশ করা যেতে পারে।
বর্তমানে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার, যা প্রশংসনীয়। প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এসব ব্যবস্থাগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পর্যটন খাত থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে এবং দেশের অর্থনীতি হবে মজবুত ও টেকসই।
লেখক: চেয়ারম্যান, ইয়ুথ ইউনিটি অব বাংলাদেশ
Leave a reply