আল মাহফুজ:
সাত নম্বর জার্সি পরে খেলেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে আইডল মানেন। তার মতো করেই গোল করার পর মাঠের এক কোণে গিয়ে লাফিয়ে ‘সিইউ’ উদযাপন করেন। হয়তো মনেপ্রাণে ‘সিআরসেভেন’ হতে চান, কিন্তু ‘এসএমসেভেন’ হলেও চলবে। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমিদের কাছে শেখ মোরসালিন এখন ‘এসএমসেভেন’। কৈশোরের সারল্য অঙ্কিত এখনও তার চোখে মুখে। তবু জাতীয় দলের হয়ে নয় ম্যাচে করেছেন চার গোল। ঘরোয়া ফুটবলেও উপহার দিয়েছেন অসংখ্য চোখ ধাঁধানো গোল। তার দূরপাল্লার গোলগুলো দেখলে বিস্মিত মনে একটা প্রশ্ন জাগে, ডি-বক্সের সামনের জায়গাটা কি মোরসালিনের বেশ পছন্দের?
মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) বিশ্বকাপ বাছাইয়ের এশিয়ান অঞ্চলে লেবাননের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ড্র (১-১) করে বাংলাদেশ। এই সমতার কারিগর মোরসালিন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বদলি গোলকিপার মেহেদি শ্রাবণের করা হাস্যকর এক ভুলে গোল হজম করার পর বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরাতে বেশি সময় নেননি এসএমসেভেন। যার প্রমাণ স্বরূপ মিনিট পাঁচেক পর ডি বক্সের বাইরে থেকে দুরন্ত শটে অবিশ্বাস্য এক গোল করেন শেখ মোরসালিন। তার বাঁক খাওয়া বুলেট গতির শট আটকানোর ক্ষমতা ছিল না লেবানন গোলরক্ষকের। আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের ফুটবলারদের এমন গোল সচরাচর দেখা যায় না। দূরত্ব, গতি, ভারসাম্য, পায়ের কাজ, অ্যাকুরেসি সকল ক্যাটাগরিতেই মোরসালিনের গোলটি অনন্য সাধারণ। গোল করে তাই তিনি দর্শকের সাথে মিশে যেতে পারেন। দর্শকও ‘মোরসালিন, মোরসালিন’ রব তোলে গ্যালারি জুড়ে।
অথচ ম্যাচটি তার খেলারই কথা ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হলুদ কার্ড দেখার কারণে ফরোয়ার্ড রাকিব হোসেনের জায়গায় একাদশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন শেখ মোরসালিন। রাকিব ম্যাচটি খেললে হয়তো একাদশে জায়গা পেতেন না মোরসালিন।
এর আগে, ২০ সেপ্টেম্বর এএফসি কাপে মাজিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ খেলে দেশে ফেরার পথে বিমানবন্দরে ৬৪ বোতলসহ কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে আটক হন পাঁচ ফুটবলার— তপু বর্মণ, আনিসুর রহমান, রিমন হোসেন, তৌহিদুল আলম সবুজ ও শেখ মোরসালিন।
যে কারণে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ক্লাব থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা পান শেখ মোরসালিন। জাতীয় দল থেকেও জায়গা হারান। এতে মাঝের সময়টাতে খেলতে পারেননি ক্লাব ও জাতীয় দলের একটি ম্যাচও। ১২ অক্টোবর তদন্ত শেষে জানা যায়, মোরসালিনের জরিমানা শুধু আর্থিক। এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে মুক্তি মিললেও জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছিলেন না। টাইগার কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার দলে তিনি হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য। অবশেষে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে ফিরলেও মাঠে নেমেছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে। লেবাননের বিপক্ষে শুরু থেকেই একাদশে ছিলেন। অবশেষে দলকে ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ একটি পয়েন্ট এনে দিয়ে জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থাটাও সেরে ফেললেন। চোখে লেগে থাকার মতো তার এক গোলেই ৭৯ ধাপ এগিয়ে থাকা লেবাননকে রুখে দিল বাংলাদেশ। পেলো বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে মূল্যবান এক পয়েন্ট।
চলতি বছর জাতীয় দলে অভিষেক হয় মোরসালিনের। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচে মালদ্বীপের বিপক্ষে তার প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। সে আসরে ভুটানের বিপক্ষে গোলটিও ছিল ডি-বক্সের বাইরে থেকে করা শটে। রাকিবের করা অন্য গোলটাতেও তার অবদান ছিল। মোরসালিন জাদুতেই দীর্ঘ ১৪ বছর পর সাফ ফুটবলের সেমিতে খেলেছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অন্য ফুটবলারের চেয়ে সতেরো বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার অনেকটাই আলাদা। মিডফিল্ডার হয়েও গোল স্কোরিং এ্যাবিলিটি দারুণ। ড্রিবলিং, পাসিং, শুটিং, গেম এওয়ারনেসে অহর্নিশ মুগ্ধতা ছড়ালেও বল কন্ট্রোলিং, রিসিভিংয়ে দুর্বলতা আছে তার (লেবানন ম্যাচে বিশেষ করে ৭৮ মিনিটে সোহেল রানার পাস থেকে মোরসালিন একটি সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিলেন। বলটা যদি যথার্থরুপে রিসিভ করতে পারতেন মোরসালিন, তাহলে গোলটা হতে পারতো এবং বাংলাদেশও পেতো ৩ পয়েন্ট)। এসব নিয়ে কাজ করতে পারলে তার পক্ষে আরও অসাধারণ কিছু অর্জন সম্ভব। তবে এটা ঠিক যে, দূরপাল্লার শটে বলের সাথে পায়ের যে সূক্ষ্ম ফিনিশিং টাচ দিতে হয়, এটা বাংলাদেশে তার মতো আর কেউ পারেন না। যার ফলে বাতাসে বল ‘সি’ শেপের মতো বাঁক খেয়ে জালে জড়ায়। শটেও অত্যধিক জোর দিতে পারেন তিনি।
‘মোরসালিন ম্যাজিক’ শুধু জাতীয় দলেই ঘটে না, ঘরোয়াতেও দূরপাল্লার শটে গোল করতে দেখা যায় তাকে। গত বছর মোহামেডানে ধারে খেলতে গিয়ে কিংসের বিপক্ষেই প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে গোল করে বসেন মোরসালিন। কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত শুরুর দিকের সেই গোল এখনও অনেকের চোখে ভাসে! মোরসালিনের বাঁক খাওয়ানো সেই শট এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে পারেননি বিপক্ষের গোলকিপার আনিসুর রহমান জিকো। বল যখন পোস্টে যাচ্ছিল, আনিসুর ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। কিচ্ছুটি করার ছিল না জাতীয় দলের এই গোলকিপারের। এরকম আরও অসংখ্য গোল আছে মোরসালিনের।
একের পর এক গোল ও আশা জাগানিয়া নৈপুণ্য দেখিয়ে বাংলাদেশ দলে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে চলেছেন এই তরুণ ফুটবলার। ‘তরুণ’ বলছি কেন! এখনও তো আঠারো বছর পেরোয়নি তার। দুদিন বাদে জন্মদিন এসএমসেভেনের। হয়তো জন্মদিনের উপহার হিসেবেই করলেন এমন অবিস্মরণীয় গোল! ফুটবলপ্রেমি দর্শকরা নিশ্চয়ই চাইবে এমন অনবদ্য আরও গোলের দেখা পেতে। তারা নিশ্চয়ই আকাঙ্ক্ষা করবে, বাংলাদেশের প্রতি ম্যাচে এক নতুন মোরসালিনের জন্ম হোক।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশে পক্ষে সর্বোচ্চ গোল আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুর (১৭ গোল)। শেখ মো. আসলাম দেশের হয়ে আরও বেশি গোল করলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ম্যাচে তার গোল কম। শেখ মোরসালিন একদা বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে চান। মোরসালিনের পক্ষে কি তা সম্ভব? শুধু প্রয়োজন খেলাটার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ ও নিবেদন রাখা। শুধু প্রয়োজন নিজের শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে যথারীতি কাজ করা। তাহলেই সম্ভব। কারণ, সময় ও বয়সটা যে মোরসালিনের পক্ষেই।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়..
Leave a reply