ব্যারিস্টার মইনুল, এক-এগারো ও অন্যান্য

|

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। ছবি: বিবিসি।

মিশুক নজিব:

এক-এগারো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও গল্পের খোরাক জোগায়। এই অধ্যায় কেবলই কি গল্পের খোরাক? নিশ্চয়ই না। বাংলাদেশের ৫২ বছরের রাজনীতিকে যদি কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়, তাহলে এক-এগারোর গল্প বরাবরই আলাদা জায়গা করে নেবে।

দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলই এক-এগারোকে কালো অধ্যায় বলে অভিহিত করে থাকে। ব্যবসায়ীদের জন্যও সুখকর ছিল না সে সময়। ক্যাম্পাসেও গড়ে উঠেছিল ছাত্র আন্দোলন। সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে সময় দেশ শাসন করে। অনির্বাচিত এই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আইন, বিচার ও সংসদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, তথ্য এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।

এক-এগারোতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন:

ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যে কয়জন উপদেষ্টাকে ঘিরে বেশ আলোচনা-সমালোচনা ছিল, তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মইনুল অন্যতম। দায়িত্বে থাকাকালে প্রতিদিনই গরম গরম কথা বলতেন তিনি। গণমাধ্যমগুলোও তার এসব কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতো। খুব কম দিনই ছিল, যেদিন তার খবর থাকতো না। বলা চলে, অনেকটা এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তবে অনির্বাচিত এই সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য থাকতে পারেননি জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী।

ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ব্যারিস্টার মইনুল উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি। আর পরের বছরের ৮ জানুয়ারি তাকে পদত্যাগ করতে হয়। এই দায়িত্বে এক বছরও পূর্ণ করতে পারেননি তিনি।

এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করতে কার্পণ্য করেননি এই উপদেষ্টা। আর তাতে সারাদেশের মানুষের কাছে আলোচনার খোরাক হয়ে উঠেছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল। তবে দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি নিয়ে তার এমন মন্তব্যকেও একসময় ছাপিয়ে যায় গণমাধ্যমে তার ভূমিকা।

প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিনে প্রকাশিত কার্টুনকাণ্ড সে সময় টপ অব দ্য কান্ট্রি বনেছিল। এই কার্টুনকাণ্ডে দেশের ইসলামিক সংগঠনগুলো রাস্তায় নামে। দৈনিকটির প্রকাশনা বন্ধে আহ্বানও জানায়। এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনও। এতে তার ভূমিকা নিয়েও রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।

মইনুল হোসেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই বন্ধ হয়ে যায় সংবাদভিত্তিক দেশের প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল সিএসবি। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা এ ঘটনায় তাকেও দায়ী করেন।

নিজের লেখা ‘গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি’ বইয়ে এ প্রসঙ্গে মইনুল হোসেন লেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রচার না করিয়া উসকানিমূলক প্রচারণার জন্য ইটিভি ও সিএসবি টেলিভিশন চ্যানেল দুইটি বন্ধ করারও কথা উঠিল। শেষ পর্যন্ত সিএসবি চ্যানেলটি বন্ধ না করিয়া পারা গেল না।

‘৭৫ এর রাজনৈতিক বাঁকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন:

১৯৭৩ সালে পিরোজপুর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল। তবে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হলে তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। যার নাম দেয়া হয়েছিল বাকশাল।

ব্যারিস্টার মইনুলসহ দুইজন সংসদ সদস্য তখন এর প্রতিবাদ করেছিলেন। অপরজন হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী।

শেখ মুজিবুর রহমানের মুত্যুর পরে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পরিচালিত দল ডেমোক্র্যাটিক লীগে যোগ দেন ব্যারিস্টার মইনুল। ৩ নভেম্বর মোশতাক সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন তিনি।

১৪-এর ভোটের আগেও আসেন আলোচনায়:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন শেষে অনেকটা অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন এই আইনজীবী। তবে, দশম সংসদ নির্বাচনের দিন নিকটে আসতেই ফের আলোচনায় আসেন ব্যারিস্টার মইনুল।

২০১২ সালের মাঝামাঝি একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আগামীতে সংসদ নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পতন অনিবার্য। এর জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া তাকে জ্ঞানপাপী হিসেবে আখ্যা দেন।

ওই বছরের আগস্টে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘রাজনৈতিক সঙ্কট: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি পুনরায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে তৃতীয় ধারার কথা বলেন।

২০১৮-এ টক শোতে বেঁফাস মন্তব্য করে কারাগারে:

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠনের চেষ্টায় সক্রিয় ছিলেন আইনজীবী মইনুল হোসেন। ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শো আলোচনায় লাইভে যুক্ত হয়েছিলেন আইনজীবী মইনুল হোসেন। এই টক শোতে আলোচকদের একজন ছিলেন মাসুদা ভাট্টি। তখন তিনি মইনুলের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আলোচনা চলছে, আপনি সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এসে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করছেন কি না?

এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার একপর্যায়ে মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলে মন্তব্য করেন মইনুল হোসেন। তার এমন মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে মইনুল হোসেনকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন।

সে সময় গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মইনুলের বক্তব্যের সমালোচনা করেন। এছাড়া তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যও তুলে ধরেছিলেন।

এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হলে ওই বছরেরই ২২ অক্টোবর গ্রেফতার হন ব্যারিস্টার মইনুল। আঠারোর ভোটের সময় জেলে ছিলেন তিনি। নির্বাচনের পরে হাইকোর্টে জামিন পেয়ে ১৪ জানুয়ারি কারাগার থেকে বেরোন এই আইনজীবী।

চব্বিশের ভোটের আগে না ফেরার দেশে:

আবারও ভোট আসছে। সেই ভোট ঘিরে মইনুল হোসেনের কোনো মন্তব্য বা তৎপরতা দেখা যায়নি। আর দেখাও যাবে না। ভোটের আগেই পরপারে পাড়ি জমালেন। শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মইনুল হোসেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

বিখ্যাত সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছেলে ব্যারিস্টার মইনুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে যুক্তরাজ্যে গিয়ে পড়াশোনা করেন আইন বিষয়ে। ১৯৬৫ সালে বার-এট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত হন মইনুল হোসেন। রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়েছিলেন।

২০০০-২০০১ মেয়াদে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন ব্যারিস্টার মইনুল। আর সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

ব্যারিস্টার মইনুল বেশ কয়েকটি বই-ও লিখেছেন। তার মধ্যে ‘গণতন্ত্রের সংগ্রামে বাংলাদেশ’, ‘গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি’, ‘অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া’ ও ‘নতজানু থাকা স্বাধীনতা নয়’ উল্লেখযোগ্য।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply