মাহফুজ মিশু ও বিএম খোরশেদ:
মুক্তিযোদ্ধা লোকমান, থাকেন মানিকগঞ্জের ঘিওরে। ছিলেন সেনাবাহিনীর সিপাহী। যুদ্ধ শুরু হলে চাকরি থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।
এই যোদ্ধার মত, সেনা-পুলিশ-ইপিআর আর আনসারের ৫০ সদস্যের প্রচেষ্টায় হয়ে ওঠে তা। বিশ্বাসঘাতক রাজাকাররা সে খবর পৌঁছে দেয় পাক হানাদারদের। তাদের টার্গেট ছিল, সেই ক্যাম্প ধ্বংস করা। কৌশলী লোকমানরা জীবন বাজি রেখে তাদের রুখে দেন গেরিলা কায়দায়। পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করতে এসে একদিনেই নিহত হয় ৮১ জন। আর পাকিস্তানের এক সেনাকে জীবিত ধরে আনেন লোকমান। সেই থেকে সতীর্থদের কাছে ‘টাইগার লোকমান’ তিনি।
২ নম্বর সেক্টরের এই মুক্তিযোদ্ধা বললেন, ৭টি নৌকাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ি। তবে এরপর ওরা আর গুলি ছুড়তে পারেনি। আখ ক্ষেতের ধারে দেখলাম, একটা সৈনিক একা। সে গুলি ছুড়তেছে। তখন তাকে ধরে আনি।
পুরোটা জীবন একাত্তরের গৌরব বয়ে চলেছেন তিনি। সতীর্থদের স্মৃতি রক্ষায় গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালা। বলছিলেন, একাত্তরে বিজয়ে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর ছিল ঐক্যবদ্ধ মানুষ। ৫২ বছরে তা হারিয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ আছে এই বীরের।
টাইগার লোকমান বলেন, ইচ্ছা অনুযায়ী দল করো। তাতে কোনো বাধা নেই, কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু দেশের স্বার্থে আপামর জনতা যদি এক থাকতে পারে, তাহলে আগামীতে এই দেশ ভালো জায়গায় যাবে।
একাত্তরে এক ছিল পুরো দেশ। তাই মাত্র নয় মাসে এসেছিল কাঙ্খিত স্বাধীনতা। তারপরের গল্পটা বিভেদ আর বিভক্তির। বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশে কোনো ইস্যুতেই একমত হতে পারেনি সবাই। অবকাঠামোসহ নানা সূচকে উন্নয়ন হলেও দেশের প্রশ্নে এক হতে না পারা কষ্ট দেয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। জীবনবাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, অনেক উন্নয়ন হলেও দেশের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারাটাই আক্ষেপ। এই সংকট কাটাতে না পারলে মাশুল গুণতে হবে বলে সতর্ক করেন তারা।
মানিকগঞ্জের আরেক মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন বলেন, ৭ কোটি লোক থেকে এখন ১৭ কোটি হয়েছে। কিন্তু একতা নেই। আজ দ্বিধা-দ্বন্ধ, দল থাকতে পারে, তবে দেশের বিপক্ষে দল থাকা ভালো না।
এই এলাকার মানুষদের কাছে শহুরে কোলাহল আর রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তবে, দেশের প্রয়োজনে যে ঐক্য সবচেয়ে জরুরি, তা ভালোই জানা তৃণমূলের এসব মানুষের।
মানিকগঞ্জের এক বৃদ্ধ জানালেন, নানা দল হওয়াতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। মানুষেরা এক হতে পারছে না। অপরদিকে, একাধিক বয়স্ক নারী জানান, মারামারি তাদের ভালো লাগে না। সেগুলো তাদের পছন্দ নয়।
চায়ের আড্ডা থেকে ফসলের মাঠ, শ্রমিক কিংবা তরুণ— বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসেব মেলে না অনেকেরই। সাথে ভয়, নিজেদের ঐক্য না থাকলে সুযোগ নিতে পারে অন্যপক্ষ।
এক কিশোরী বললেন, ফেসবুকে-ইউটিউবে এখন দুই-তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। আগে এক হতে পারলেও এখন কেন পারছে না, এমন প্রশ্ন তুলেন আরেক কিশোরী। তাদের সকলেরই বিশ্বাস, একতাবদ্ধ বাংলাদেশকে হারাতে পারবে না কেউই।
/এমএন
Leave a reply