ছবিতে দুজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। যারা কয়েক ঘণ্টা আগেও এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে ছিল। নিজেদের কাজে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যারা হয়তো চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল প্রিয়জন বা কোনো বন্ধুর সঙ্গে। এখন তারা নিষ্প্রাণ। এখন তাদের নাম ধরে আর কেউ ডাকবে না। বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুনে পুড়ে অথবা ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে শ্বাস হারিয়ে তারা একেকজন এখন একেকটা মরদেহ।
তারা দুজনই তরুণ। শরীরে যৌবনের গন্ধ জানান দেয়া তরুণ। এদের দেখেই হয়তো হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন– এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। তারা যুদ্ধে যেতে পারেনি অথবা পেরেছে। জীবন যুদ্ধে যুঝে যুঝে হয়তো তারা জয়ী হওয়ার পথে ছিল। হয়তো তাদের মূল যুদ্ধ সামনে অপেক্ষমান ছিল। কিন্তু সেসব যুদ্ধের অনুষঙ্গ কিবা তরঙ্গ বাজিয়ে দেখার আগেই পার্থিব পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো তাদের।
আগুনের সঙ্গে যুদ্ধে নিষ্প্রাণ দলের একজন যাত্রী হলেন তুষার হাওলাদার। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়েছেন। কাজ করতেন ‘দ্য রিপোর্ট’ পত্রিকায়। গত মাসে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন বলে জানা যায়। বৃহস্পতিবার রাতে সম্ভবত কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে গিয়েছিলেন। হয়তো অনেক দিন না দেখা কোনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু করাল বাস্তবতা হচ্ছে, এখন আর তিনি নেই।
নিষ্প্রাণ, স্পন্দনশূন্য দলের আরেকজন হলেন নাঈম আহমেদ। বেইলি রোডের বহুতল ভবনটিতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতেন। হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যায়, খবরটি শুনলে– মাত্র তিনদিন আগে কাজ শুরু করেন তিনি। তিন দিন পর অর্থাৎ মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে যদি তিনি কাজে যোগ দিতেন, তাহলে হয়তো একটি তাজা প্রাণ বেঁচে যেতো।
যুবকটির বাড়ি বরগুনা। তার বাবার নাম নাট্টু মিয়া। মৃত্যুর আগে বাবাকে কল করেছিলেন নাঈম। বাবা জানান, আমাকে ফোন করেছিল নাঈম। আমি বলেছি ‘তুমি ছাদে থাকো, আল্লাহ ফয়সালা করে দিবে। তুমি নিচে নাইমো না। সবার সাথে ছাদেই থাকো।’ বাবার সাথে ছেলের এটাই হয় শেষ কথা। এরপর বাবার কলে ছেলের ফোন বেজে উঠলেও আর কোনো কথা হয়নি।
আমরা কল্পনা করি– নাঈম হয়তো আগুনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার কথা ভাবছিলেন আর মনে মনে বাবাকে বলছিলেন, রোজা শেষে ঈদে বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু নাঈম জানেন না, এই শহরের আরেক নাম মৃত্যুপুরী। নাঈম জানেন না, এই শহরের আগুন কখনও নেভে না। এই শহর থেকে তাই ঈদে বাড়ি ফেরা কঠিন। বেশ কঠিন।
এমন নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দ মিছিলের যাত্রী রয়েছেন আরও অনেকেই। কেউ আছেন ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউবা প্রকৌশলী। আগুনের লেলিহান শিখায় মৃত্যু হয়েছে কারও পরিবারের ৩ জন। কেউবা হারিয়েছেন পরিবারের ৫ সদস্য।
নাঈমের বাবা বলেন, ‘কার কাছে বিচার চামু, আমার ছেলে তো কফিনে। ছেলে তো আর পাব না।’ আমরাও বলি, এই পোড়া শহরে কার কাছে বিচার চাব? এই আগুন আলোর শহর একমুহূর্তেই কেন শ্মশানে পরিণত হয়? আমরা কার কাছে এই মৃত্যুপুরীর কথা বলব? কার বুকের শোক কতদিন বয়ে বেড়াব? কারণ, এই শহরে মৃত্যুর মিছিল কখনোই শেষ হয় না। এই শহরের আগুন নির্বাসনে যায় না।
‘আগুন, তুমি পাহাড়ে হারাও
আগুন, তুমি সমুদ্রে জল নাও
আগুন, তুমি নির্বাসনে যাও
মধ্যরাতের ভুল পথ, ভুল বাতাস..’
গ্রন্থনা: আল মাহফুজ
Leave a reply