মানবজাতির বিবর্তনের মতো মানুষের মুখের ভাষারও বিবর্তন হয়। ভাষা হলো বহমান নদীর মতো। ভাষার প্রধান উপাদান বর্ণমালারও বিন্যাস বা প্রকরণগত বিবর্তন হয়ে থাকে। বাঙালির বাল্যশিক্ষার উদ্বোধন হয় সাধারণত সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি’ বইয়ের মাধ্যমে। সেখান থেকেই বর্ণপরিচয়ের সূত্রপাত। কারও কারও ভাষার পত্তন ‘শিশুশিক্ষা’ বা ‘আদি বাল্যশিক্ষা’র মাধ্যমে।
১৮৪৯ থেকে ১৯৪৮, এই একশ’ বছরে প্রকাশিত আটটি বর্ণপরিচয় বইয়ের সংকলন করেছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। সেসব কীভাবে ছাপা হতো, তার সুলুক সন্ধান চালিয়েছেন তিনি। বাংলা আদি বর্ণপরিচয়ের ধারণা দিতে আয়োজন করা হয়েছে প্রদর্শনী ‘প্রাইমার টু প্রেস’।
শুক্রবার (৩ মে) বিকেলে রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা প্রচ্ছদশিল্পীর এই প্রদর্শনী চলবে ১৮ মে পর্যন্ত।
প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে– গত ১০০ বছরের বাংলা বর্ণমালার অক্ষরবিন্যাস ও রূপে একটা বিবর্তন রয়েছে। এটা মানবজাতির বিবর্তনের মতোই অবশ্যম্ভাবী। সব্যসাচী এই বিবর্তনের নান্দনিকতা নিয়ে কাজ করছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর পর দেশের অন্যতম প্রধান প্রচ্ছদশিল্পী এখন সব্যসাচী হাজরা।
প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে একটি লেটার প্রেস যন্ত্র। শত বছর আগে হরফ সাজিয়ে বাংলা বর্ণ ছাপার প্রক্রিয়াটা দেখানোর জন্য। দর্শনার্থীদের এব্যাপারে সহায়তা করছেন একজন মুদ্রাকর।
গ্যালারিজুড়ে সাজানো হয়েছে সেই শতকের মধ্যে প্রকাশিত বইগুলোর নানা বর্ণ, শব্দ ও বাক্যের ছবি। শিল্পীর সংগৃহীত পুরাতন বই, বিভিন্ন সময়ের হরফের নমুনাও সেখানে দেখা যাবে।
কবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয়’। এটি বাংলা প্রাইমার নিয়ে বিস্তৃত অন্বেষণের ফলাফল। বর্ণমালা বইয়ের ঐতিহাসিক উপাত্ত এবং তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর লেটারিং, সম্পাদনা ও মুদ্রণ কৌশলের বিবর্তন উন্মোচন করেছেন এই শিল্পী।
নতুন বইটিতে সংকলিত হয়েছে মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত ‘শিশুশিক্ষা’, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাক প্রণীত ‘বাল্যশিক্ষা’, সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শ লিপি’, যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রণীত ‘হাসিখুসি’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ‘চিত্রাক্ষর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ও নন্দলাল বসু অলংকৃত ‘সহজ পাঠ’ এবং বিপলচন্দ্র ঘোষ প্রণীত সত্যজিৎ রায় অলংকৃত ‘হাতেখড়ি’ বইগুলো।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য, ডিজাইনার ও শিল্পী চন্দ্র শেখর সাহা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার পরিচালক ফ্রঁসোয়া ঘ্রোজ এবং সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দ। আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুঁই।
উল্লেখ্য, রোববার বাদে সোম থেকে শনিবার প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রদর্শনী ঘুরে আসা যাবে। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত।
সব্যসাচী হাজরা (জন্ম ১৯৭৮) বাংলাদেশের একজন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রচ্ছদশিল্পী ও লেখক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কন ও চিত্রকলায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রচ্ছদ ডিজাইন, ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন ও ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি ডিজাইন থেকে শুরু করে প্রকাশনা শিল্পে লেআউট, ইলাস্ট্রেশন পর্যন্ত তার কর্মপরিধি।
/এএম
Leave a reply