অলডার্নি দ্বীপ: হাজার হাজার বন্দিদের জন্য পৃথিবীতে একটি ‘নরক’

|

অলডার্নি দ্বীপ। ছবি: বিবিসি।

আহাদুল ইসলাম:

১৯৪৫ সাল! ‘অলডার্নি’ ইংলিশ চ্যানেলের একটি শান্ত ব্রিটিশ দ্বীপ যা অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। তবে একসময় ব্রিটিশ মাটিতে এটি একমাত্র নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত ছিল। অনেকের মতে এই দ্বীপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাজার হাজার বন্দীদের জন্য পৃথিবীতে একটি ‘নরক’ হিসেবে কুখ্যাত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ উপকূল থেকে মাত্র ৭০ মাইল দূরে ‘অলডার্নি’ নামের ছোট এই দ্বীপটি আধিপত্য বিস্তারের জন্য হিটলারের কৌশলের বিশেষ অংশ হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি, এই দ্বীপে হোলোকাস্ট পরবর্তী ইস্যুগুলির জন্য যুক্তরাজ্যের বিশেষ দূত এরিক পিকলস দ্বারা নির্দেশিত বিশেষজ্ঞদের একটি বিশেষ প্যানেলের নেতৃত্বে একটি নতুন তদন্ত করা হয়েছে। অলডার্নিতে বন্দি অবস্থায় শ্রমিকদের সঠিক মৃত্যুর সংখ্যা বের করতে এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বের স্থায়ীভাবে ইতি টানতে নেয়া হয়েছে এমন পদক্ষেপ।

অলডার্নি’তে প্রাণ হারানো বহু মানুষের স্মরণে বিভিন্ন ভাষায় লেখা ফলক। ছবি: সিএনএন নিউজ।

‘অলডার্নি’ হল ব্রিটিশ অধ্যুষিত চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জ, যেটি ১৯৪০ সালে জার্মানরা দখল করেছিল। তখনকার সময়ে প্রায় ১৫শ’ বাসিন্দাদের মধ্যে বেশিরভাগই যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে অল্প সংখ্যকই রয়ে গিয়েছিল দ্বীপটিতে, যাদের পরবর্তীতে জোরপূর্বক দাস কিংবা শ্রমিক হিসেবে অনিশ্চিতভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হয়।

তবে হঠাৎ কেন এই দ্বীপের কথা বলা হচ্ছে। ঐতিহাসিক সংরক্ষণাগারগুলো খুঁজলে দেখা যাবে, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনী এই দ্বীপেই প্রায় ২৭টি দেশের বন্দীদের নৃশংস অবস্থায় রেখেছিল। এখানেই ৪টি ক্যাম্পে বন্দীদের এতোটাই অমানবিক আচরণ করা হয়, যা বর্ণনা করারও ভাষা ছিলনা অনেক বিশ্লেষকদের। দ্বীপটি জার্মানদের থেকে স্বাধীন হবার পর তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ১৯৪৫ সালে ‘এস-এস লেজার সিলট’ ক্যাম্পে ৩৮৯ জন বন্দির মৃত্যু হয়।

দ্বীপটি ৫ বছর ধরে দখলে ছিল নাৎসিদের কাছে। ছবি: বিবিসি।

তবে অনেক বিশ্লেষকদের ধারণা, মৃতের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। অলডার্নি দ্বীপের অধিবাসীদের অনেকে ইতিহাসের এই ভয়ঙ্কর সময়কে ঘিরে মানসিক বিপর্যয় এবং এর প্রভাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

যুক্তরাজ্যের হলোকাস্ট দূত লর্ড পিকলস, যিনি পর্যালোচনার আদেশ দিয়েছিলেন, এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মৃতদের সত্যিকার সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সত্য বের হওয়া উচিত। মৃতরা সত্যের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীদের বিকৃতি থেকে মুক্ত পাবার জন্য মৃতদের সঠিক সংখ্যা জানার আসল দাবিদার অলডার্নির বাসিন্দারা’।

৮৮ বছর বয়সী আইরিস প্রিজেন্ট ওই দ্বীপে তার স্বামীকে অত্যাচারের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, তার স্বামী ‘গর্ডন প্রিজেন্ট’ এর বয়স ছিল তখন ১৯ বছর। ১৯৪৩ সালে, জার্মানরা যখন তাকে তাদের জন্য কাজ করার দাবি জানায় তখন তারা জার্সিতে থাকতেন। প্রিজেন্ট প্রত্যাখ্যান করায় জার্মান কর্তৃপক্ষ তাকে অলডার্নিতে নিয়ে যাওয়ার আগে কঠোর শাস্তি দেয়।

গর্ডন প্রিজেন্টকে অল্ডারনিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জার্মানদের জন্য কাজ করানো হয়। ছবি: বিবিসি।

গর্ডন প্রিজেন্টকে জোর করে অলডার্নিতে নিয়ে যাওয়ার পর স্বল্প খাদ্য এবং নিয়মিত মারধরসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

গর্ডন প্রিজেন্ট নাৎসিদের অত্যাচারের অভিজ্ঞতার পর সেখান থেকে ফিরে বহুদিন দুঃস্বপ্ন ও মানুসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। ছবি: বিবিসি।

ব্রিটিশ হলোকাস্ট মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ১১টি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেলকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছিল। যেসব বন্দিরা এই দ্বীপে নাৎসি ক্যাম্পে যুদ্ধের সময় বন্দী হয়ে জীবন হারিয়েছে, তাদের প্রকৃত সংখ্যা বের করতে। গত সপ্তাহের বুধবার, তাদের সঠিক পরিসংখ্যান ফলাফলগুলি প্রকাশ করা হয়। নথিতে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে এই দাবির পক্ষে ‘সঠিক প্রমাণ’ নথিতে উল্লেখ করা হয়নি।

পর্যটন বোর্ডের মতে, অলডার্নি দ্বীপের বাসিন্দারা যারা জনসংখ্যায় মাত্র ২ হাজার; প্রতি বছরের মে মাসে দ্বীপে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধের সামনে জড়ো হয়।

বাসিন্দাদের দাবি, পর্যাপ্ত রেকর্ডের অভাবের অল্ডারনি এবং সেখানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।

অবর্ণিত সত্য:

নাৎসিদের কাছ থেকে দ্বীপটি মুক্তির পর, যুদ্ধোত্তর তদন্তের সরকারী পরিসংখ্যানে বন্দিদের মৃতের সংখ্যা ৩৮৯ উল্লেখ করা হলেও, এই পরিসংখ্যান দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ, ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য এবং জনসাধারণের অনুমান, মৃতের সংখ্যা কয়েকশ’ থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত।

বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্বীপটিতে যা ঘটেছিল তার প্রকৃত সংখ্যা ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করেছে।

তদন্ত নথিতে এই ধরনের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। প্রকাশিত নথিতে বলা হয় অলডার্নিতে মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ১শ’ ৩৪ জন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা ৬৪১ থেকে ১ হাজার ২৭ জনের মধ্যে।

নাৎসি বাহিনী দ্বারা আল্ডারনিতে পাঠানো আনুমানিক সর্বনিম্ন বন্দি বা শ্রমিকের সংখ্যা ৭ হাজার ৬শ’ আটজন থেকে ৭ হাজার ৮শ’ বার জনের মধ্যে।

অনুসন্ধান অনুসারে, অলডার্নি’র শিবিরগুলোর শ্রমিকদের নৃশংস ও নির্মম অবস্থায় রাখা হয়েছিল এবং বিপজ্জনক নির্মাণ কাজ চালিয়ে দীর্ঘ সময় তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই সাথে মারধর, নির্যাতন এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়েছিল শ্রমিকরা।

তবে তদন্তে দেখা গেছে যে হাজার হাজার ভুক্তভোগীরা যে আসলেই মারা গেছে; এমন যুক্তির পেছনে ‘কোন প্রমাণ’ নেই। তাছাড়াও প্যানেলের দাবি, অলডার্নিতে যে নাৎসি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিলো এবং একটি “মিনি-অশউইৎস” ক্যাম্প গঠন করা হয়েছিলো তাও অসত্য।

বুলেটের ছিদ্র যেখানে বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ছবি: সিএনএন নিউজ।

তবে প্রকাশিত নতুন নথিতে যাই বলা হোক না কেন, বন্দিদের সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছিল, তা এই দেয়ালে গুলির ছিদ্র দেখলে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। কারণ- প্রাণ নিয়ে পালাতে দেয়াল টপকানো মোটামুটি অসম্ভব।

এমন একটি সময়ে যখন ইউরোপের কিছু অংশ হলোকাস্টের সেই ভয়াবহ ইতিহাস থেকে ধুয়ে ফেলতে চাইছে, তখন ব্রিটিশ এই অলডার্নি দ্বীপটি অবশ্যই অবিকৃত সত্য হিসেবে থেকে যাবে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য!



সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply